রোগীদের প্রতিষেধক, সান্তনা এবং ব্যবস্থাপত্র। - ২
এগারতম প্রতিষেধকঃ
হে র্ধৈর্যহীন অসুস্থ ভাই!
বর্তমানে তোমার অসুস্থতা তোমাকে কষ্ট দেয়। অতীতের অসুস্থতা থেকে মুক্তির মাঝে আধ্যাত্মিক আনন্দ পেয়েছিলে এবং যে সওয়াব অর্জন করেছিলে তার রূহানী স্বাদ উপভোগ করেছ।
আজ থেকে হয়ত এই মুহূর্ত থেকে কোন অসুখ বা কষ্ট থাকবে না। আর না থাকলে ব্যথিত হবার কোন কারণ নেই।
তুমি অহেতুক এক ধরণের ভীতি পোষণ করে ধৈর্যহীনতার পরিচয় দিচ্ছি। সওয়াব ও রোগ মুক্তির আনন্দ যখন তোমার কাছে রয়ে যায় তখন অতীত থেকে আজ পর্যন্ত অসুস্থতা দূর করার কষ্টও দূরীভূত হয়ে যায়। তুমি অহেতুক ভীতি পোষণের ধৈর্যহীনতার পরিচয় দিও না। ভবিষ্যতের দিনগুলো যেহেতু আসে নি অজানা দিনগুলোতে অজানা কষ্ট কল্পনা করে ব্যথিত হবার এবং ধৈর্যহীনতার পরিচয় দিয়ে ‘অজানা’ অস্তিত্বকে রং দেয়া পাগলামী ছাড়া আর কিছু নয়।
যেহেতু অতীতের অসুস্থতার সময় গুলো তোমাকে আনন্দ দিচ্ছে, এবং যেহেতু এই মুহূর্তের পরের সময়গুলো অজানা, অসুখও অজানা, কষ্টও অজানা সেহেতু তুমি আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত ধৈর্যশক্তিকে ডানে বামে খরচ না করে, এখনকার কষ্টের বিরুদ্ধে কর। “ইয়া সাবুর “ বলে ধৈর্য ধারণ কর।
বারতম প্রতিষেধকঃ
হে অসুস্থতার কারণে ইবাদত ও যিাকর -আযকার থেকে বঞ্চিত এবং এই বঞ্চনার কারণে ব্যথিত ব্যক্তি!
একটি হাদীস মনে রেখ। অসুস্থতার কারণে মুত্তাকী এক মুমিন তার নিয়মিত যিকির করতে না পারলেও অসুস্থতার সময় সে যিকিরের সওয়াব পাবে। যে রোগী ধৈর্য ও তায়াক্কুল সহকারে ফরযকে আদায় করে। কঠিন অসুস্থতার সময় সুন্নত আদায় করতে না পারলেও সুন্নতের ঐ সওয়াবগুলো খালিসভাবে আদায় হয়। অসুস্থতা একটি কাজ করে। তা হল মানুষের মাঝে বিদ্যমান অক্ষমতা ও অসহায়ত্বকে অনুভব করে। এই অক্ষমতা ও দুর্বলতার ভাষায় বরং আচরণ ও কথার মাধ্যমে দোয়া করিয়ে নেয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মানুষকে সীমাহীন অক্ষমতা ও দুর্বলতা দিয়ে তৈরী করেছেন যাতে সে সর্বদা ইলাহীর দরবারে আশ্রয় ও দোয়া প্রার্থনা করে। “দোয়াই যদি না থাকবে তবে তোমাদের মূল্যই কি আছে। মানুষের মূল্যবান হবার কারণ আন্তরিক দোয়া ও প্রার্থনা।
তেরতম প্রতিষেধকঃ
অসুস্থতা থেকে অভিযোগকারী হে উপায়হীন ব্যক্তি!
অসুস্থতাকে ইলাহীর পক্ষ থেকে এক মূল্যবান উপহার হিসাবে ধরুন। প্রত্যেক রোগীর উচিত অসুস্থতাকে এভাবে উপলব্ধি করা।
একটি বিষয় মনে রাখতে হবে । যেহেতু মৃত্যুক্ষণ সুনির্দিষ্ট নয়। আল্লাহ হিকমতের জন্য মৃত্যুক্ষণ গোপন রেখেছেন। মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতের প্রয়োজনে ভয় ও আশার মাঝে রেখেছেন। মৃত্যুক্ষণ যে কোন সময় আসতে পারে। মানুষ যদি গাফলত ও উদাসীনতার মাঝে মারা যায় তবে চিরন্তন জীবনের চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কিন্তু অসুস্থতা, গাফিলতিকে দূর করে, আখিরাতকে নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য করে ও মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এভাবে মানুষকে মৃত্যুর জন্য তৈরী করে। বিশ দিনের অসুস্থতা কোন ব্যক্তিকে এমন এক মর্তবায় পৌঁছে দিতে পারে যা বিশ বছরে পৌঁছান সম্ভব নয়।
অসুস্থতা দ্বারা যে লাভ ও উপকারিতা পাওয়া যায় তা থেকে অভিযোগ নয় বরং রোগীর দায়িত্ব হচ্ছে সে তাওয়াক্কুল ও সবরের দ্বারা শুকরিয়া আদায় করে আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করা।
চৌদ্দতম প্রতিষেধকঃ
হে পর্দাবৃত চোখের অধিকারী রোগী!
তোমরা যদি জানতে ঈমানদারদের চোখে যে পর্দা আছে তার অন্তরালে নূর ও আধ্যাত্মিক এক চোখ আছে। তাহলে তোমরা বলতে “আমার দয়াময় রবের কাছে লক্ষবার কৃতজ্ঞতা জানাই। এটাই একটি প্রতিষেধক। একজন মুমিনের চোখে পর্দা পড়লে এবং অন্ধ অবস্থায় যদি কবরে প্রবেশ করে তবে মর্তবা অনুযায়ী অন্যান্য কবরবাসীর চেয়ে অনেক বেশী নূরের জগতকে দর্শন করতে পারে। আমরা এই দুনিয়াতে অনেক কিছু দেখতে পাই। কিন্তু অন্ধ মুমিনরা দেখতে পায় না। কিন্তু তারা যখন কবরে যায় অন্যান্য কবরবাসী হতে বেশী পরিমাণে দেখতে পায়। তারা জান্নাতের বাগানকে সিনেমার মত দেখতে পারে। তাদের চোখের পর্দার আড়ালে বিদ্যমান শোকর ও সবরের দ্বারা তা খুঁজে পায়।
পনেরতম প্রতিষেধকঃ
হে হায় হুতাশকারী রোগী!
অসুস্থতার বাহ্যিক রূপ দেখে ‘উহ’ বলো না। এর মর্ম অনুধাবন করে ‘আহ’ বলো। অসুস্থতার যদি সুন্দর তাৎপর্য না থাকত তবে খালিকে রহীম আল্লাহ তার সবচেয়ে প্রিয় বান্দাদের অসুস্থতা দিতেন না। হাদীসে আছে “মানুষের মাঝে সবচেয়ে উত্তম, সবচেয়ে কামিল ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশী মুসিবত ও কষ্টের সম্মুখীন হয়। “
যেমন আইউব (আঃ) , আম্বিয়া গণ, আউলিয়া গণ এবং দ্বীনদার গণ তাদের অসুস্থতাকে একটি খালিছ ইবাদত এবং রাহমানী উপহার হিসাবে উপলব্ধি করেছেন। ধৈর্যের মাধ্যমে শুকরিয়া আদায় করেছেন। তারা সব ধরণের অসুস্থতাকে খালিক রহীমের রহমত থেকে আগত এক ধরণের অস্ত্রোপচার হিসাবে বিবেচনা করেছেন। তাই বলছি হে বেদনা প্রকাশকারী রোগী ! এই নূরানী কাফেলায় যোগ দিতে চাইলে সবরের মাধ্যমে শুকরিয়া আদায় কর। যদি অভিযোগ করতে থাক তবে আর তাদের কাফেলায় স্থান পাবে না। অন্ধকার পথে ধাবিত হবে।
হ্যাঁ ‘ এমন কিছু রোগ আছে যেগুলোতে মৃত্যুবরণ করলে আধ্যাত্মিক শহীদ হওয়া যায়। যেমন সন্তান প্রসবকালীন সময়ে , পেটের পীড়ায়, পানিতে ডুবে, আগুনে পুড়ে কিংবা মহামারীতে মৃত্যু বরণ করলে শহীদ হিসাবে গণ্য হয়। এরকম আরো অনেক অসুস্থতা আছে যেগুলোতে মৃত্যুবরণ করলে রোগী ওলীর মর্যাদা লাভ করে। এই অসুস্থতা যখন দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা ও আকর্ষণকে কমিয়ে দেয় তখন অনেক দুনিয়া পুজারীর জন্য মৃত্যুর পীড়া ও বেদনাকে প্রশমিত করে। অনেক সময় মৃত্যুটাকে তার কাছে প্রিয় করে দেয়।
ষোলতম প্রতিষেধকঃ
কষ্টসমূহ থেকে অভিযোগকারী হে রোগী!
অসুস্থতা মানুষের সামাজিক জীবনে তিনটি গুণাবলীর বিকাশ ঘটায়। তা হচ্ছে দয়া, শ্রদ্বা এবং একটি সুন্দর গুণ অমুখাপেক্ষিতা। কারণ অসুস্থতা মানুষকে একাকীত্ব এবং দায়হীনতার দিকে পরিচালনাকারী অমুখাপেক্ষিতার হাত থেকে রক্ষা করে। সূরা আলাকের ৬৭ নং আয়াতে আল্লাহ এরশাদ করেছেন, “ নিঃসন্দেহে মানুষ সীমা লংঘন করে এ কারণে যে সে নিজেকে অভাবমুক্ত (স্বয়ংসম্পূর্ণ) মনে করে।
এখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় সুস্থতা ও সরলতা থেকে উদ্ভূত অমুখাপেক্ষিতা। এর মধ্যে নিহিত আছে নাফসে আম্মারা, শ্রদ্বার পাত্র ভাইয়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করা এবং দয়া ও স্নেহ-মমতা পাওয়ার অধিকারী মুসিবতগ্রস্থ রোগীদের দয়া না করা।
যখন একজন ব্যক্তি অসুস্থ হয় এবং ঐ অসুস্থতার দ্বারা তখন সে নিজের অক্ষমতা ও দুর্বলতাকে বুঝতে পারে এবং তখন সে শ্রদ্ধার যোগ্য ভাইদের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে। তখন সে মনে করে মুমিন অসুস্থ ভাইদের প্রতি সাক্ষাৎ করা এবং সহায়তা করার। তখন সে মানুষ হিসাবে মুসিবতগ্রস্তদের প্রতি দয়া অনুভব করে। তার ভিতরে মানবিক দয়া ও ভালবাসা উদ্ভূত হয়। তারা তখন চেষ্টা করে পরিপূর্ণভাবে মুসিবতগ্রস্থের দুঃখ অনুভব করতে, স্নেহ-মমতা প্রদর্শন করে এবং সব রকম ভাবে সাহায্য করতে। আর যদি কিছু না করতে পারে তবে অন্তত দোয়া করে, সুন্নত হিসাবে রোগীকে দেখতে যায় বা খোঁজ-খবর নেয়। সওয়াব অর্জন করে।
সতেরতম প্রতিষেধকঃ
অসুস্থতার ফলে কল্যাণের কাজ করতে না পারার কারণে অভিযোগকারী হে রোগী!
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর। অসুস্থতা তোমার জন্য পূণ্যময় কাজের পথটি খুলে দিয়েছে। অসুস্থতার ফলে রোগী এবং তাকে খেদমতকারী- উভয়ের জন্য সওয়াবের কারণ। তার দোয়া কবুলের সর্বেৎকৃষ্ট ওসিলা।
রোগীর খেদমতের মাঝে, ঈমানদারদের জন্য প্রচুর সওয়াব আছে। রোগীর খোঁজ-খবর নেয়া, রোগীকে কষ্ট না দিয়ে সাক্ষাৎ করা সুন্নত ও গুনাহ মাফের উসিলা। হাদীসে আছে রোগীর দোয়া গ্রহণ কর। কারণ তাদের দোয়াসমূহ মাকবুল। রোগী যদি আত্মীয়-স্বজন হয় বিশেষ করে বাবা-মা। তবে তাদের খেদমত এক সুউচ্চ ইবাদত এবং বিশাল সওয়াব। রোগীর হৃদয়কে জয় করা ও সান্তনা দেয়া সুউচ্চ সদকা। ঐ সন্তান সৌভাগবান যে সন্তান বাবা-মায়ের অসুস্থতার সময় দুঃখ ভারাক্রান্ত হবার সাথে সাথে তাদের মনকে খুশী করে দোয়া অর্জন করে। এই খেদমতকারী সন্তানকে ফেরেশতারাও ‘মাশাল্লাহ, বারাকাল্লাহ’ বলে করতালি দেয়।
এই দোয়া এক ধরণের ইবাদত। রোগী অসুস্থতা দ্বারা নিজের দুর্বলতাকে বুঝে আল্লাহর দরবারে আশ্রয় গ্রহণ ও প্রার্থনা করে। অনেক বছর থেকে সুস্থতার জন্য দোয়া করছি। আপাতদৃষ্টিতে দোয়া কবুল হয় নি। তবুও মনে হয় নি দোয়া ছেড়ে দেই। কারণ অসুস্থতা দোয়ার সময়।
আর দোয়া যদি আমরা যেভাবে চেয়েছিলাম সেভাবে কবুল না হয় তাহলে বলা যাবে না দোয়া কবুল হয় নাই। আল্লাহ ভাল জানেন। আমাদের জন্য যা কল্যাণকর তা তিনি দান করেন। কখনও দুনিয়ার জন্য আমাদের করা দোয়াসমূহকে আমাদের আখিরাতের মঙ্গলের জন্য গ্রহণ করেন।
উপসংহারে বলতে পারি, অসুস্থতার দ্বারা পরিচ্ছন্নতা লাভকারীর বিশেষ করে দুর্বলতা, অক্ষমতা, অসহায়ত্ব এবং প্রয়োজন থেকে করা দোয়া খুব বেশী গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। অসুস্থতা এরকম খালিস দোয়ার উৎস। রোগী এবং রোগীর খেদমতকারী ব্যক্তিগণ এই দোয়া থেকে লাভবান হয়।