মুক্তি ও সফলতার শর্ত।

বার্ধক্য আসার সাথে সাথে শারিরীক অক্ষমতার শুরু। কিন্তু মন বুড়ো হয় না। মন সর্বক্ষণ কাজ করতে থাকে। কিছু না কিছু নিয়ে ভাবতেই থোকে আর সে সাথে আসে মানসিক অবসাদ। এই মানসিক অবসাদ দূর করার একটি উপায় হল আত্মিক উন্নতি।


তা করতে গিয়ে দুটো বই অনুসরণ করছি। একটি হল পবিত্র কুরআন আর আরেকটি মসনবী শরীফ। পার্থিব জীবনে  যে শারিরীক  ও মানসিক জটীলতা সৃষ্টি হয় তা থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায় হচ্ছে প্রজ্ঞা আহরণ করা। আর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে দেখা।   


রুমীর  একটি গল্প এবং তার সাথে তার মর্মার্থ নিয়ে ভাবছিলাম। গল্পটি হল  এক নৌকার মাঝির সাথে এক নাহবী আলেমের কথোপকথন। নাহমী আলেম হল একজন ব্যকরণবিদ। অনেক বিদ্যা অর্জন করেছেন। রুমী এভাবে বর্ণনা করেেছেন। 
জনৈক নহু শাস্ত্রের পন্ডিত নৌকায় চড়ল। 
পথে আত্মম্ভরী পন্ডিতজী নৌকার মাঝিকে সম্বোধন করল –
পন্ডিতজী জিজ্ঞেস করল , তুমি কি নহু শান্ত্র কিছু পড়েছ,,
মাঝি উত্তরে বল্ল, না পড়িনি । 
পন্ডিতজী বলল, তোমার অর্ধেক জীবন বরবাদ হয়ে গিয়েছে। 
মাঝি হতবাক হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে নীরব রইল, কোন উত্তর দিল না।  
ইতিমধ্যে প্রবল ঝড় নৌকাকে ঘূর্ণাবর্তে পতিত করল, 
তখন মাঝি উচ্চঃস্বরে নহরী পন্ডিতকে জিজ্ঞাসা করল - 
ওহে পন্ডিতজী বলুন, সন্তরণবিদ্যা কিছুটা জানেন কি? 
পন্ডিতজী বলল, না ভাই আমার দ্বারা সাঁতারের আশা রেখো না। 
মাঝি বলল, ওহে পন্ডিতজী ! আপনার তো সারাটা জীবনই দেখছি বরবাদ হচ্ছে
কেননা নৌকা ঘূর্ণাবর্তে নিমজ্জিত হচ্ছে।
মনে রেখ, এখানে একাগ্রতা ও নিমগ্নতার প্রয়োজন, ব্যকরণ শাস্ত্রের পন্ডিতের প্রয়োজন নেই। 
তুমি যদি (আল্লাহর ভাবে) মগ্ন হয়ে থাক , তবে নির্ভয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দাও।  
যেমন নৌকা নিমজ্জিত ও জলমগ্ন হবার সময় সন্তরণ প্রয়োজন, ব্যকরণ শাস্ত্রের পন্ডিতের প্রয়োজন  নাই। অন্য যে কোন শিল্প বিদ্যা এখানে অকেজো, তদ্রূপ আল্লাহর পথ অতিক্রম করার জন্য ফানা ও আত্মবিলুপ্তির প্রয়োজন। বিজ্ঞান, শিল্প কলা চর্চা সবই এখানে বৃথা।

এই জীবনে কিছু মানুষ আছে যারা অহংকার আর দম্ভে অন্ধ। যারা ইহকালীন জীবন নিয়ে মহাব্যস্ত। । সত্য ও ন্যায়ের অনুসারীদের কষ্টের জীবনকে ঘৃণা করে। তাদেরকে উপহাস করে তারাই মূর্খ। তারা নিজেদের জ্ঞানী মনে করে। আসলে তারা মূর্খ। মাঝ দরিয়ার ঘূর্ণাবর্ত অতিক্রম করতে হলে সাঁতার জানতে হয়। সেটাই সে জানেনা। তাই রুমী বলছেন তুমি অহংকারে বেসামাল হয়ো না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ কর। নিজেকে বড় করার বাতিক ছেড়ে তুমি কিভাবে মিশিয়ে দিবে ছোট করবে , বিলীন করবে সে দীক্ষা নাও। আত্মবিলীন হবার দীক্ষা তোমাকে নিতে হবে। জীবনে যদি তুমি সার্থক হতে চাও তবে ব্যকরণবিদ নয় তাহলে তোমাকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। অহংকার ও দম্ভ নয়।

জীবনে সার্থক হতে চাইলে জ্ঞান নিয়ে বা দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে আত্মম্ভরী হবার নয় এগুলোকে মিটিয়ে দেবার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। যদি তুমি নিজেকে আত্মবিলীন করতে পার, অহংকারকে দমন করতে পার তবে এই জীবন নামক উত্তাল সাগরে পাড়ি  দিতে পারবে।

যারা নিজেকে অনেক চালাক চতুর ভাবে তাদের জন্য এখান থেকে একটি বড় শিক্ষা এই যে, নিজের জীবনে ঝড় এলে বোঝা যায় সেই ঝড় সামলাতে পারছি কিনা?  



ছোটবেলায় স্কুলে  সুকুমার রায়ের একটি কবিতা পড়েছিলাম। কবিতার বিষয়বস্তু ছিল । জ্ঞানের গর্বে গর্বিত এক পন্ডিত নৌকায় করে নদী পার হচ্ছিলেন। নিজের জ্ঞান প্রমাণ করার জন্য মাঝির জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে উপহাস করেন । ইতিহাস না জানায় পন্ডিত মনে করেন মাঝির জীবনের এক চতুর্থাংশ নষ্ট হয়ে গেছে । ভূগোল সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় অর্ধেক জীবন এবং বিজ্ঞান না জানায় জীবনের তিন -চতুর্থাংশ নষ্ট। এরপর হঠাত্‌ আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল এবং ঝড় উঠল। 


এর  শেষ অনুচ্ছেদটুকু কবির কবিতা থেকে তুলে দিলাম।

.

"খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,

বাবু দেখেন, নৌকাখানি ডুবলো বুঝি দুলে!

মাঝিরে কন, '' একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,

ডুবলো নাকি নৌকা এবার? মরব নাকি আজি?''

মাঝি শুধায়, ''সাঁতার জানো?''- মাথা নাড়েন বাবু,

মূর্খ মাঝি বলে, ''মশাই, এখন কেন কাবু?

বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,

তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!''

.

.

আমাদের চারপাশে তথাকথিত অনেক "জ্ঞানী" মানুষদের ছড়াছড়ি। কিন্তু বড় দুঃখের বিষয় - এই অধিকাংশ জ্ঞানী ব্যক্তিরা পরকাল বিশ্বাস করে না। তাই এরা  তাদের জ্ঞান নিয়ে এত গর্বিত তারা সাধারণ বিশ্বাসীদের উপহাস করতে কোন সুযোগই ছাড়ে না।জ্ঞানী ব্যক্তিদের জ্ঞান ক্বিয়ামতের দিন "ষোলো আনাই মিছে" বলে প্রমানিত হবে।

.

আমাদের "আসমুদ্র হিমাচল জ্ঞান" যদি আমাকে জাহান্নামের অবর্ণনীয় দুর্দশা থেকে রক্ষা করতে না পারে, যদি সর্বনিকৃষ্ট দুর্যোগের দিন আমাদের নিজের-ই বিন্দুমাত্র উপকারে না আসতে পারে, তবে কী লাভ সেই জ্ঞানের?

আমরা সারাজীবন অনেক অনেক জ্ঞান আহরণ করেছি এবং এখনো করছি।আমরা ভুলে যাই সবার মধ্যে সব গুণ থাকে না। আল্লাহ কোন মানুষ যে কাজ করে তাকে সেই জ্ঞান দেন। পন্ডিতকে যেমন পড়ানোর দক্ষতা দিয়েছেন আর মাঝিকে দিয়েছেন তার প্রয়োজনীয় সাঁতারের জ্ঞান। এ নিয়ে অহমিকা করার কিছু নেই।  অহমিকার  জ্ঞান কি আমাকে পরকালের শান্তি এনে দিতে পারছে? না- 

তাই মহান আল্লাহর কাছে এমন জ্ঞান প্রার্থনা করি যা আমার জন্য উপকারী। পরকালের দুঃখ-দুর্দশা থেকে আমাকে রক্ষা করবে। এমন জ্ঞান চাই না যাতে মনে "ষোল আনাই মিছে। আমীন। 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url