সূরা হুদ। রুকু ৮ । হযরত শোয়াইব (আঃ) ও তাঁর জাতি।
কুরআন পড়ুন, বুঝে পড়ুন
নিজে জানুন, অন্যকে বলুন।
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্রাহর নামে শুরু।
সূরা হুদ : রুকু ৮
আয়াত ৮৪ - ৯৫
শোয়াইব (আঃ) ও তাঁর জাতি।
৮৪ নং আয়াত::শোয়াইব (আঃ) এর মাদইয়ানে অবস্থান।
---------------------------------------------------------------------------------------------
(৮৪) মাদইয়ানবাসীদের নিকট তাহাদের ভ্রাতা শোয়াইবকে আমি পাঠিয়েছিলাম। সে বলিয়াছিল, 'হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর 'ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নাই, মাপে ও ওজনে কম করিও না; আমি তোমাদেরকে সমৃদ্ধিশালী দেখিতেছি, কিন্তু আমি তোমাদের জন্য আশঙ্কা করিতেছিএক সর্বগ্রাসী দিবসের শাস্তি।
---------------------------------------------------------------------------------------------
হযরত শোয়াইব (আঃ)কে মাদইয়ান বাসীদের কাছে পাঠান হয়েছিল।
তিনি তাদেরকে আল্লার এক এবাদত করার জন্য আহ্বান করেন।
তিনি তাদেরকে মাপে ও ওজনে কম দিতে নিষেধ করেন।
তাদেরকে সর্বগ্রাসী দিবসের শাস্তির জন্য সতর্ক করেন।
যদিও তারা অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী জাতি ছিল।
৮৫ নং আয়াত : মাপ ও ওজনে কম দেয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা
---------------------------------------------------------------------------------------------
(৮৫) 'হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে মাপিও ও ওজন করিও, লোকরেকে তাহাদের প্রাপ্য বস্তু কম দিও না এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করিয়া বেড়াইও না।
---------------------------------------------------------------------------------------------
তাদের ব্যবসা বাণিজ্যে শঠতার আশ্রয় নিত। অর্থ্যাত্ মাপে ও ওজনে কম দিত।
তাদের মধ্যে সততা ছিলনা।
এর ফলে পৃথিবীতে তারা বিপর্যয় সৃষ্টি করে ৮৬ নং আয়াত: মুমিন কে?
---------------------------------------------------------------------------------------------
(৮৬) 'যদি তোমরা মুমিন হও তবে আল্লাহ -অনুমোদিত যাহা বাকি থাকিবে তোমাদের জন্য তাহা উত্তম; আমি তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক নই।
---------------------------------------------------------------------------------------------
মাপে ও ওজনে কম দিয়ে হারাম পদ্ধতিতে আয় না করে, সঠিক মাপে ও ওজন দিয়ে হালাল পদ্ধতিতে আয় করে।
শোআইব তার জাতির তত্ত্বাবধায়ক নন। তার পক্ষে সম্ভব নয় তার জাতিকে অপকর্ম করা থেকে ফিরিয়ে রাখবেন।
৮৭ নং আয়াত: শেয়াইবের বিরুদ্ধে তার জাতির অভিযোগ।
---------------------------------------------------------------------------------------------
(৮৭) উহারা বলিল, 'হে শোয়াইব! তোমার সালাত কি তোমাকে নির্দেশ দেয় যে, আমাদের পিতৃপুরুষেরা যাহার 'ইবাদত করিত আমাদেরকে তাহা বর্জন করিতে হইবে অথবা আমরা আমাদের ধন-সম্পদ সম্পর্কে যাহা করি তাহাও? তুমি তো অবশ্যই সহিষ্ঞু, ভাল মানুষ!
---------------------------------------------------------------------------------------------
শোয়াইব সালাত কি নির্দেশ দেয় তা জানতে চান। তারা দুটি প্রশ্ন করেন।
প্রথমত সালাত কি পিতৃপুরুষরা যাদের ইবাদত করত তা পরিত্যাগ করতে বলে ?
দ্বিতীয়ত: তাদের ব্যক্তিগত ধন সম্পদ যেভাবে খুশী সেভাবে ব্যবহার করবে। সেখানেও সালাতের কোন নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা?
৮৮ নং আয়াত ::হযরত শোয়াইব (আঃ) এর বক্তব্য।
---------------------------------------------------------------------------------------------
(৮৮) সে বলিল, ' হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা ভাবিয়া দেখিয়াছ কি, আমি যদি আমার প্রতিপালক -প্রেরিত স্পষ্ট প্রমাণে প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকি এবং তিনি যদি তাঁহার নিকট হইতে আমাকে উত্কৃষ্ট জীবনোপকরণ দান করিয়া থাকেন তবে কী করিয়া আমি আমার কর্তব্য হইতে বিরত থাকিত। আমি তোমাদেরকে যাহা নিষেধ করি আমি নিজে তাহা করিতে ইচ্ছা করি না। আমি তো আমার সাধ্যমত সংস্কারই করিতে চাই। আমার কমর্মসাধন তো আল্লাহরই সাহায্য ; আমি তাঁহারই উপর নির্ভর করি এবং আমি তাঁহারই অভিমুখী।
---------------------------------------------------------------------------------------------
শোয়েব (আঃ) তার জাতিকে সম্বেধন করে বলছেন, যে তারা চাচ্ছে তিনি যেন তওহীদ ও ন্যায়নীতি অবলম্বনের যে বাণী প্রচার করছেন তা বন্ধ করেন।
আমার পক্ষে তা থেকে বিরত থাকা সম্ভব নয়।
কারণ মহান আল্লাহ আমাকে স্পষ্ট প্রমাণ অর্থ্যাত্ নবুয়্যত দান করেছেন।
আল্লাহ তাঁকে উত্কৃষ্ট রিযিক (রিযিক বলতে বেঁচে থাকার জন্য পানাহার এবং যে সকল সামগ্রী প্রয়োজন ) দান করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সরল পথে থেকে রিযিক দান করেছেন। তবে তিনি কেন এসব অর্জনের জন্য ভ্রান্ত পথ অবলম্বন করবেন।
আল্লাহ তাঁকে এত নিয়ামত দিয়েছেন তারপরে তিনি কেন তাকে দেয়া দায়িত্ব সম্পাদন করবেন না।
তিনি উলোটা তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে জানতে চান কেন তিনি তার জাতির অনুসরিত ভ্রান্ত পথে চলবেন।
তিনি তাঁর জাতিকে যে কাজ করতে নিষেধ করেন আড়ালে গিয়ে বা পিছনে থেকে নিজে সেসব কাজ করেন না।
আমার উদ্দেশ্য ও কাজ হচ্ছে সাধ্যমত সংস্কার করা।
আমি যা কিছু করছি তা আল্লাহর সাহাযে্য করছি।
আমি সব সময় আল্লাহর উপর নির্ভর করে আছি।
প্রতিটি বিষয়ে আল্লাহর কথা মনে রাখি। কারণ আমি আল্লাহর কাছে সমপির্ত।
হযরত শোয়াইবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য::
- তাঁর কথার মধ্যে তওহীদের অমোঘ দৃঢ়তা ছিল।
- আল্লাহ তাঁকে যে নেয়ামত দিয়েছেন তার জন্য শোকর করতেন।
- তিনি আল্লাহর প্রেরিত নবী ছিলেন।
- আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পাদনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
- আল্লাহর আদেশকে তাঁর কর্তব্য হিসাবে গ্রহণ করেছেন।
- তিনি অন্যকে যে কাজ করতে নিষেধ করেন নিজে তা করেন না।
- তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারক ।
- মানুষকে তাদের কল্যাণের জন্য উপদেশ দিতেন।
- সব কাজে আল্লাহর উপর নির্ভর করতেন।
- আল্লাহ ছাড়া আর কারো মুখাপেক্ষী ছিলেন না।
৮৯ নং আয়াত: শোয়াইব (আঃ) এর সতর্কবাণী।
---------------------------------------------------------------------------------------------
(৮৯) 'হে আমার সম্প্রদায়! আমার সঙ্গে বিরোধ যেন কিছুতেই তোমাদেরকে এমন অপরাধ না করায় যাহাতে তোমাদের উপর তাহার অনুরূপ বিপদ আপতিত হইবে যাহা আপতিত হইয়াছিল নূহের সম্প্রদায়ের উপর অথবা হুদের সম্প্রদায়ের উপর কিংবা সালিহ সম্প্রদায়ের উপর। ; লূতের সম্প্রদায় তো তোমাদের হইতে দূরে নয়।
---------------------------------------------------------------------------------------------
শোয়াইব (আঃ) এর সাথে মতানৈক্য হলে তার জাতি যে ধ্বংসের সম্মুখীন হবেন সে সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে।
উদাহরণ হিসাবে আগের নবী নূহ (আঃ) , হুদ (আঃ) সালিহ (আঃ) এবং লুত (আঃ) এর কথা বলা হয়েছে।
নবীদের বিরোধিতা করে তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
৯০ নং আয়াত: ক্ষমা প্রার্থনা।
---------------------------------------------------------------------------------------------
(৯০) 'তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর ও তাঁহার দিকে প্রত্যাবর্তন কর; আমার প্রতিপালক তো পরম দয়ালু, প্রেমময়।'
---------------------------------------------------------------------------------------------
শোয়াইব (আঃ) তার জাতিকে বিগত দিনে যে সব অপরাধ করেছে তার জন্য ক্ষমা চাইতে ।
লজ্জা ও অনুতাপ জর্জরিত অন্তরে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর।
মহান আল্লাহ পরম করুণাময় এবং প্রেমময়।
৯১ নং আয়াত : শোয়াইবের প্রতি তার জাতির হুমকি।
---------------------------------------------------------------------------------------------
(৯১) উহারা বলিল, ' হে শোয়াইব ! তুমি যাহা বল তাহার অনেক কথা আমরা বুঝি না এবং আমরা তো আমাদের মধ্যে তোমাকে দুর্বলই দেখিতেছি। তোমার স্বজনবর্গ না থাকিলে আমরা তোমাকে প্রস্তর নিক্ষেপ করিয়া মারিয়া ফেলিতাম; আর আমাদের উপর তুমি শক্তিশালী নও।'’
---------------------------------------------------------------------------------------------
তার জাতি নাকি শোয়াইব (আঃ) কি বলতে চান তা তারা বোঝেন না।
এখানে উল্লেখ্য তিনি পৌত্তলিকত্ বিরোধী ও সততাপূর্ণ কথা বলতেন। যা শুনতে তারা পছন্দ করত না।
তাদের কাছে মনে হচ্ছে তিনি একজন শক্তিহীন দুর্বল মানুষ।
শোয়াইবের আত্মীয়-স্বজন না থাকলেতাঁকে ডাথর মেরে মেরে ফেলত।
তারা মনে করত তার আত্মরক্ষার শক্তি নাই।
৯২ নং আয়াত: হযরত শোয়াইব (আঃ) এর উত্তর ১
---------------------------------------------------------------------------------------------
(৯২) সে বলিল, 'হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের নিকট কি আমার স্বজনবর্গ আল্লাহ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী? তোমরা তাঁহাকে সম্পূর্ণ পশ্চাতে ফেলিয়া রাখিয়াছ। তোমরা যাহা কর আমার প্রতিপালক অবশ্যই তাহা পরিবেষ্টন করিয়া আছেন।
---------------------------------------------------------------------------------------------
শোয়াইব (আঃ) তার জাতির কাছে জানতে চান তাদের কাছে কি তাঁর স্বজনবর্গ আল্লাহ অপেক্ষা বেশী বিবেচ্য??
এখানে তারা আল্লাহ অপেক্ষা তার বংশমর্যাদাকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছে।
মহান আল্লাহ তোমাদের সব কার্যকলাপ সম্পর্কে জানেন এবং সময়মত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
৯৩ নং আয়াত : হযরত শোয়াইব (আঃ) এর উত্তর।
---------------------------------------------------------------------------------------------
(৯৩) 'হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যেমন করিতেছ করিতে থাকম আমিও আমার কাজ করিতেছি; তোমরা শীঘ্রই জানিতে পারিবে কাহার উপর আসিবে লঞ্ছনাদায়ক শাস্তি এবং কে মিথ্যাবাদী। সুতরাং তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করিতেছি।
--------------------------------------------------------------------------------------------
তিনি তার জাতিকে বলেন তোমরা স্বীয় শত্রুতার উপর প্রতিষ্ঠিত থাক।
সময়মত তোমাদের উপর ল্ঞ্ছনাদায়ক শাস্তি নেমে আসবে।
তখন বুঝতে পারবে কে মিথ্যা কথা বলছে। আমি না তোমরা?
তোমরা প্রতীক্ষা কর। আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করছি।
৯৪ নং আয়াত:: শোয়াইবের জাতির শাস্তি।
--------------------------------------------------------------------------------------------
(৯৪) যখন আমার নির্দেশ আসিল তখন আমি শোয়াইব ও তাহার সঙ্গে যাহারা বিশ্বাস করিয়াছিল তাহাদিগকে আমার অনুগ্রহে রক্ষা করিলাম, অতঃপর যাহারা সীমালংঘন করিয়াছিল মহা নাদ তাহাদিগকে আঘাত করিল, ফলে উহারা নিজ গৃহে নতজানু অবস্থায় শেষ হইয়া গেল।
---------------------------------------------------------------------------------------------
শোয়াইব (আঃ) ও তাঁর অনুসারীরা আল্লাহর অনুগ্রহে রক্ষা পায়।
প্রচন্ড শবাদ এসে তাদের আঘাত হানে।
সীমা লংঘনকারীরা তারা নিজ নিজ গৃহে ধ্বংস হয়ে যায়।
৯৫ নং আয়াত:: শোয়াইব (আঃ) এর জাতির ধ্বংস।
---------------------------------------------------------------------------------------------
(৯৫) যেন তাহারা সেথায় কখনও বসবাস করে নাই। জানিয়া রাখ! ধ্বংসই ছিল মাদিয়ানবাসীদিগের পরিণাম, যেখাবে ধ্বংস হয়েছিল সামুদ সম্প্রদায়।
----------------------------------------------------------------------------------------------
অনুধাবন:
ওজন ও মাপে কম দেয়া দন্ডনীয় অপরাধ। মানুষকে তার প্রাপ্যবস্তু না দেয়া অর্থ হল মানুষের অধিকার খর্ব করা। তার পাওনা থেকে বঞ্চিত করা।
আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করলে এবং শঠতার আশ্রয় না নিলে লাভ থাকবে এবং তাতে বরকত দিবে।
আল্লাহর আইন সব কিছুর মধ্যে সমতা বিধান করে। কখনো বলে না যে নিজেকে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করতে হবে। নিজের ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং প্রয়োজন মিটাবার পর যা উদ্বৃত্ত থাকে তাদিয়ে ভাল কাজ করলে আল্লাহর রহমত ও বরকত দুটোই পাওয়া যায়।
শোয়াইব (আঃ) ও তাঁর জাতির ইতিহাস থেকে আমাদের এই শিক্ষা নেয়া উচিত আমাদের আচরণে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠতা না থাকলে ধ্বংস অনিবার্য।