সূরা কাহফ। রুকু ৫। ক্ষণস্থায়ী ও চিরস্থায়ী জীবন।
কুরআন পড়ুন, বুঝে পড়ুন
নিজে জানুন, অন্যকে বলুন।
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু
সূরা কাহফ। রুকু ৫
এখানে দুটো ব্যক্তির গল্প বলা হয়েছে যার মধ্যে একজন পার্থিব জীবনের ঐশ্বর্য ধন্য অপর জন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে গৌরব বোধকারী।
যে ব্যক্তি দুটো বাগানের মালিক সে ধনসম্পদের প্রচুর্যে দিশেহারা হয়ে তার স্রষ্টা মহান আল্লাহর কথা ভুলে গেছেসে মনে করে তার পৃথিবীর এ সম্পদ অবিনশ্বর ও চিরস্থায়ী।তার ধারণ পৃথিবীর কোন শক্তি তার ক্ষতি করতে পারবে না।আর ইমানের গর্বে গর্বিত ব্যক্তি মনে করে নেয়ামতদাতার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ অপরিহার্য।সে তার কথা বার্তায় কখনো সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করেনা এবং অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।
বাগানের মালিক তার বন্ধুকে নিয়ে বাগানে প্রবেশ করে এবং দম্ভভরে তার দরিদ্র বন্ধুকে বলে,আমি তোমার থেকে ধন-সম্পদ ও জনশক্তিতে অনেক বেশী শক্তিশালী।
সে আল্লাহর নেয়ামতের শোকর আদায় করে না।তার ধারণা ফল বাগান কখনো ধ্বংস হবে না এবং কেয়ামত হবে না।আর যদি হয়ই তবে যেহেতু পৃথিবীতে সে অনেক ধন-সম্পদের মালিক। ঐ জগতেও তাই হবে।
[দ্রষ্টব্য: আমরা আমাদের চারপাশের দিকে তাকালে দেখতে পাই সম্পদশালী ও পরাক্রমশালী লোকেরা অহংকারের বশে ভাবে যে, ইহকালে বসে যেরকম কতৃর্ত্ব চালাচ্ছে তেমনি পরকালে বসেও করবে।]
আরেকদিকে তার দরিদ্র বন্ধু যার সেরকম ধন সম্পদ নেই কিন্তু তার আল্লাহর উপর ইমান আছে বলে সে গর্বিতসে মনে করে পৃথিবীর যাবতীয় ধন-সম্পদের থেকে শ্রেষ্ঠতর ও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে ইমান।আল্লাহর আনুগত্য করতে পেরে সে গর্বিত।
দরিদ্র বন্ধুটি তার বড়লোক বন্ধুর যাবতীয় কার্যকলাপকে ঘৃণা করে এবং সে তাকে বলে;মহান আল্লাহ তাকে মাটি ও পানির মরতা তুচ্ছ বিষয় দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।তার উচিত হল মহান আল্লাহর প্রতি সম্মান ও আদব প্রকাশ করা।তাকে সতর্ক করার সাথে সে নিজের জন্য প্রার্থনা করে বাগান ও ফসলের চেয়ে উত্কৃষ্ট কোন কিছু।
এখানে শিক্ষা হল ইমানদার মানুষ নিজের ইমান নিয়ে গর্ব বোধ করে।সে ধনবল বা জনবল নিয়ে গর্ব করে না এবং সে চাহিদাও তার নেই।তার বিত্তবৈভব নিয়ে কোন অহংকার নেই।তার বন্ধুকে সে যেভাবে উপদেশ দিচ্ছিল তা তেকে বোঝা যায় সে সত্যের ব্যাপারে আপনজনের সাথে আপোষ করে নাসে আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা করে এবং তাকেই সর্বোত্তম জিনিস বলে মনে করে।
এরপর এ কাহিনীতে মোড় দেখা যায়।সমৃদ্ধি ও উত্পাদনের দৃশ্য থেকে মহান আল্লাহ ধ্বংসের দৃশ্যে উপনীত হন।অহংকারী বাগানের মালিকের বাগান ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় সে মহান আল্লাহর অস্তিত্ব বুঝতে পারে এবং তওবা ও অনুশোচনা করেএ পর্যায়ে এসে সে আল্লাহর একত্ব এবং আনুগত্য মেনে নেয়।সে স্বীকার করে আল্লাহর সাহাযে্যর বিকল্প নেই।
এই গল্পে দেখানো হয়েছে এই পৃথিবীর জীবন এই বাগানের মতই নগণ্য এবং ধ্বংসশীল।এ নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই।
৩২ নং আয়াত::
----------------------------------------------------------------------
৩২. আর আপনি তাদের কাছে পেশ করুন দু ব্যক্তির উপমা: তাদের একজনকে একজনকে আমরা দিয়েছিলাম
দুটো আংগুরের বাগান এবং দুটিকে আমরা খেজুর গাছ দিয়ে পরিবেষ্টন করেছিলাম ও
এ দুটির মধ্যবর্তী স্থানকে করেছিলাম শস্যক্ষেত্র।
---------------------------------------------------------------------
৩৩ নং আয়াত:
----------------------------------------------------------------------
৩৩. উভয় বাগানই ফল দান করত এবং এতে কোন ত্রুটি করত না। আর আমরা উভয়ের ফাঁকে ফাঁকে প্রবাহিত করেছিলাম নহর।
----------------------------------------------------------------------
৩৪ নং আয়াত::
----------------------------------------------------------------------
৩৪. এবং তার প্রচুর ফল-সম্পদ ছিল। তারপর কথা প্রসঙ্গে তার বন্ধুকে বলল, ধন সম্পদে আমি তোমার চাইতে বেশী এবং জনবলে তোমার চেয়ে শক্তিশালী।
------------------------------------------------------------------------
ধনী ব্যক্তি দরিদ্র ব্যক্তির সাথে তুলনা করা শুরু করে এবং নিজের ধন সম্পদ নিয়ে আত্ম অহংকার করতে থাকে।
- তার ধারণা এ ধন সম্পদ চিরস্থায়ী।
- সে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় আল্লাহর কাছে চারিত্রিক গুণাবলী বেশী গ্রহণযোগ্য।
৩৫ নং আয়াত::
----------------------------------------------------------------------
৩৫. আর সে তার বাগানে প্রবেশ করল নিজের প্রতি যুলুম করে। সে বলল, আমি মনে করি না যে, এটা কখনো ধ্বংস হয়ে যাবে।
----------------------------------------------------------------------
- দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন অর্থ, জনবল ও তার প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে অহংকারী হয়ে ওঠে।
- আরেকজনের কিন্তু চারিত্রিক গুণাবলী ও বিনয়ে তারতম্য ঘটেনি।
- যে আত্ম গর্বে মত্ত হয় সে যে তার প্রতিবেশীর সাথে অসংযত আচরণ করে তা নয়,সে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করে নিজ আত্মার।
- ধনসম্পদের প্রাচুর্য ও মোহ তার অন্তদৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
- যখন এই খারাপ রিপু মানুষকে আচ্ছন্ন করে তখন আর আল্লাহর নূর তার অন্তরে আর প্রবেশ করতে পারে না
এবং সে সত্যকে চিনতে পারে না।
- আধ্যাত্মিক জগত তার অন্ধকার হয়ে পড়ে।
৩৬ নং আয়াত::
----------------------------------------------------------------------
৩৬. আমি মনে করি না যে, কেয়ামত সংঘটিত হবে।আর আমাকে যদি আমার রবের কাছে ফিরিয়ে নেয়াও হয়, তবে আমি তো নিশ্চয়ই এর চেয়ে উত্কৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল পাব।
----------------------------------------------------------------------
— ধন সম্পদের জন্য লোলুপতা এবং আকাংখাকে তুলে ধরা হয়েছে।
— অর্থাত্ জাগতিক বিষয়ের উপর আকর্ষণ বেশী।
— তারা পৃথিবীর সুখের মাপকাঠি হিসাবে ধন-সম্পদ ও প্রভাব প্রতিপত্তিকে মনে করে।
— তারা জানেনা তাদের সুখের সংজ্ঞা চোরাবালির উপর দাঁড়ানো যার কোন মজবুত ভিত্তি নেই
— অর্থসম্পদ খুবই ক্ষণস্থায়ী যা পরকালের জীবনে কোন প্রভাব ফেলবে না।
৩৭ নং আয়াত:
----------------------------------------------------------------------
৩৭. তদুত্তরে তার বন্ধু বিতর্কমূলকভাবে বলল, তুমি কি তাঁর সাথে কুফরী করছ যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি ও পরে বীর্য থেকে এবং তারপর পূর্ণাঙ্গ করেছেন মানুষ্য আকৃতিতে
----------------------------------------------------------------------
- মানুষের সৃষ্টির ৩চি ধাপ।
১ম ধাপ শূণ্য থেকে মাটি যা দিয়ে মানব দেহ তৈরী।
২য় ধাপ বীর্য যা মানুষের শরীরে তৈরী হয়।
৩য় পিতামাতার ভূমিকা। শুক্রের কথা উল্লেখ আছে।
৩৮. কিন্তু আমি বলি, তিনি আল্লাহই আমার প্রতিপালক এবং আমি কাউকেও আমার প্রতিপালকের শরীক করি না।
- অহংকারী ব্যক্তির সংগী আত্মগর্ব ও আল্লাহকে অস্বীকার করার প্রতিবাদ করেন।
- সে তার আধ্যাত্মিক চেতনা দ্বারা বুঝে আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়।
- তিনি একমাত্র প্রভু।
- সে তার সঙ্গীকে আল্লাহর অনুগ্রহ ও অনুকম্পার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বলে।
- আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য নিজে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
- অকৃতজ্ঞতার জন্য সে তার সঙ্গীকে সাবধান করে দেয়।
- আল্লাহর ক্রোধ যে কোন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ রূপে আসতে পারে।
৩৯ আয়াত:
----------------------------------------------------------------------
৩৯. তুমি যখন তোমার বাগানে প্রবেশ করলে তখন কেন বললে না, আল্লাহ যা চান তাই হয়, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আর কোন শক্তি নেই? তুমি যদি ধনে ও সন্তানে আমাকে তোমার চেয়ে নিকৃষ্টতর মনে কর –
----------------------------------------------------------------------
- অত্যাধিক অহংকার ও গর্ব আল্লাহ সহ্য করেন না।
৪০ নং আয়াত:
----------------------------------------------------------------------
৪০. তবে হয়ত আমার রব আমাকে তোমার বাগানের চেয়ে উত্কৃষ্টতর কিছু দেবেনে এবং তোমার বাগানে আকাশ থেকে নির্ধারিত বিপর্যয় পাঠাবেন, যার ফলে তা উদ্ভিদশূন্য ময়দানে পরিণত হবে।
----------------------------------------------------------------------
৪১ আয়াত::
----------------------------------------------------------------------
৪১. অথবা তার পানি ভূগর্ভে হারিয়ে যাবে এবং তুমি কখনো সেটার সন্ধান লাভে সক্ষম হবে না।
----------------------------------------------------------------------
৪০ ও ৪১ আয়াতে আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ ব্যক্তির উপদেশ।
- তার দৃঢ় আস্থা আল্লাহর উপর যে তিনি এই ব্যক্তিকে অহংকারী বন্ধুর চাইতে আরো ভাল পুরষ্কার দিবেন।
- আল্লাহর শাস্তি আকাশ থেকে নেমে আসবে। বজ্রপাত বা অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় হতে পারে।
- মাটির স্তর থেকে পানি সরে গিয়ে জমি অনুর্বর হয়ে পড়তে পারে।
৪২ নং আয়াত:
----------------------------------------------------------------------
৪২. আর তার ফল-সম্পদ বিপর্যয় বেষ্টিত হয়ে গেল এবং সে তাতে যা ব্যয় করেছিল তার জন্য হাতের তালু মেরে আক্ষেপ করতে লাগল যখন সে মাচানসহ ভূমিতে লুটিয়ে পড়ল। সে বলতে লাগল, ‘হায়, আমি যদি কাউকে আমার রবের সাথে শরীক না করতাম!
----------------------------------------------------------------------
- এখানে তিনটি শব্দ লক্ষণীয়। ফল-সম্পদ, ব্যয় করা এবং আক্ষেপ করা। এই শব্দ তিনটি রূপক।
- ফল-সম্পদ অর্থ পৃথিবীতে প্রতিটি কর্মের নির্দিষ্ট প্রতিফল আছে। [ অহংকারী ব্যক্তি তার বাগানের বদৌলতে প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হয়্ এর জন্য সে পরিতৃপ্ত এবং বিলাসী জীবনের অধিকারী।তার সমস্ত চিন্তাভাবনা আবর্তিত হয় জাগতিক বিত্ত বৈভব নিয়ে। পার্থিব সুখ সম্পদের বাইরে সে চিন্তা করতে পারে না। তার আশা আকাঙ্খা পার্থিব সুখ সম্পদের মধ্যে সীমাব্ধ। ]
- ব্যয় করা অর্থ হল ব্যক্তি তার শ্রম, মেধা, মননশীলতা, পরিশ্রম, চিন্তা, ভাবনা, আবেগ সব কিছু সে ব্যয় করে পার্থিব ফল লাভের জন্য।
- আক্ষেপ করা। ক্পার্থিব লাভ ক্ষণস্থায়ী আল্লাহর চিন্তা স্থায়ী। ক্ষণস্থায়ী লাভ যখন ধূলিসাত্ হয়ে যায় তখন সে অনুশোচনা করতে থাকে। যা তার হাত থেকে চলে গেছে তা আর ফিরে পায় না।
- সাধারণত দেখা যায় বাত্ম অহংকার বা গর্ব মানুষকে আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পরিবর্তে তাকে উদ্ধত করে তুলে।
৪৩ নং আয়াত:
----------------------------------------------------------------------
৪৩. আর আল্লাহ ছাড়া তাকে সাহায্য করার কোন লোকজন ছিল না এবং সে নিজেও প্রতিকারে সমর্থ হলো না।
----------------------------------------------------------------------
- সাধারণত দেখা যায় সম্পদশালী রোকেরা সব সময় তার কৃপা প্রার্থী ও চাটুকার লোক দ্বারা পরিবৃত থাকে। কিন্ত যখন তার ক্ষমতা থাকে না তখন আর তার চারপাশের এসব লোকদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
- সে নিজেও নিজেকে সাহায্য করতে পারে না।
৪৪ নং আয়াত:
----------------------------------------------------------------------
৪৪. এখানে রক্ষা করার যাবতীয় এখতিয়ার একমাত্র আল্লাহতায়ালার, যিনি একমাত্র সত্য, পুরষ্কারদানে ও পরিণাম নির্ধারণে তিনিই উত্তম।
----------------------------------------------------------------------
- একমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে ইহকাল ও পরকালে সাহায্য আসে।
- গর্ব ও অহংকার সময়ের পরিক্রমায় বিলীন হয়ে যায়।