বার্ধক্য ভাবনা। ৭৫ বছর
৭৫ বছরের জন্মদিনে।
আর সাথে সাথে মনে করিয়ে দিবে অনন্ত জীবনের ঢোকার দ্বারে আরো এক বত্সর এগিয়ে গেলে। তোমার বয়সের দালান-ঘর থেকে প্রতিদিন একটি একটি করে পাথর খসে পড়ছে। সে ক্ষয়ে যাচ্ছে।
১০০ বছরকে একটি ইউনিট ধরি তবে তার ৪ ভাগের ৩ ভাগ অতিক্রম করলাম।আমি আল্লাহর রহমত বয়স-বৃক্ষ পেয়ে ধন্য। এই মাইলফলক আমার জীবনকে প্রতিফলিত করে দেখার এক উপযুক্ত সময়।
বার্ধক্যে পা রাখার সাথে সাথে অসুস্থতাও চলে আসল।মাথার চুলের শুভ্রতার সাথে সাথে নানা দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে খেতে ঘুম থেকে বিরত রাখতে লেগেছে। উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করছি - কেন ?
উত্তর খুঁজে পেলাম বদিউজ্জামান সাঈদ নূরসীর বইতে " জীবন সায়োহ্নে আলোর হাতছানি।"
ভেবে দেখলাম - আমাদের যৌবনের আশা-আকাংখা ও প্রত্যাশা এই পৃথিবীর সাথে দৃঢ়ভাবে বেঁধে রেখেছিল। বার্ধক্যের জগতে পা রাখার পর তা বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে। নুরসীর ভাষায় বলছি।
আমি আমার ডান দিকে অর্থ্যাৎ অতীতের দিকে তাকিয়ে সান্তনা খোঁজ করছিলাম তখন অতীত আমার বাবা, দাদা এবং মানবজাতির এক বিরাট 'কবর' প্রকাশ করল। সান্তনার পরিবর্তে তা আমাকে আরো হতাশ করে দিল।
আমি আমার বাম দিক অর্থ্যাৎ ভবিষ্যতের দিকে সমাধান খোঁজার জন্য তাকালাম। তখন ভবিষ্যৎ আমার নিকট আমার জন্য, আমার পরিচিত অন্যান্যদের জন্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বড় অন্ধকারাচ্ছন্ন কবরের আকৃতিতে প্রকাশ পেল।
তা আমাকে হৃদ্যতার পরিবর্তে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলল। আমি ডান ও বাম দিক হতে নিরাশ হবার পর আমার বর্তমান দিনের দিকে তাকালাম। এই বর্তমান দিনটি আমার উদাসীন এবং ইতিহাসের দৃষ্টির সামনে সেই কফিনের আকৃতিতে প্রকাশ পেল, যা এমন একটি দেহের জানাযা বহন করছে যার অর্ধেক মৃত এবং যবাইকৃত প্রাণীর মত কাতরাচ্ছে।
আমি এই প্রান্ত থেকে নিরাশ হবার পর আমার মাথা তুললাম এবং জীবন বৃক্ষের চূড়ার দিকে তাকালাম। আমি দেখতে পেলাম, এই বৃক্ষের একটি ফল রয়েছে। আর তা হচ্ছে আমার 'জানাযা' । আর এই ফল গাছের উপর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি এই দিক থেকেও ভীত হলাম এবং আমার মাথা নুয়ে এল।
আমি এই বয়স-বৃক্ষের নিচে অর্থ্যাত্ তার শিকড়ের দিকে তাকালাম। দেখতে পেলাম যে, আমার সৃষ্টির প্রথমের মাটি এবং হাড়ের মাটি নিচের মাটির সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে পায়ের নীচে পিষ্ট হয়ে আছে। এমনিভাবে তা আমাকে আমার দুশ্চিন্তার কোন প্রতিষেধক দিতে পারে নি বরং আমার বেদনাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
অতঃপর বাধ্য হয়ে আমি আমার পেছনের দিকে তাকালাম। তখন আমি দেখতে পেলাম ভিত্তিহীন এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী ধ্বংসের অন্ধকার নদী এবং নিঃশেষের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। অতঃপর সেই দিক আমার দুশ্চিন্তার বিষক্রিয়া বাড়িয়ে দিল, যেই মুহূর্তে আমি প্রতিষেধক খুঁজছিলাম। এমনিভাবে আমি সেই প্রান্তেও কোনো কল্যাণ পাই নি।
আমি সামনের দিকে তাকালাম। আমি দেখতে পেলাম, ঠিক আমার পথেই কবরের দরজা উন্মুক্ত হয়ে আমার দিকে মুখ খুলে তাকিয়ে আছে। আর তার পিছনে এমন এক পথ দেখা যাচ্ছে, যা অনন্তের দিকে প্রলম্বিত এবং যার ওপর দিয়ে অনেক কাফেলা পরিভ্রমণ করছে।
এই ছয় দিক থেকে আসা বিভিন্ন ভয় ও বিভিষীকার মোকাবেলায় নির্ভরতার কেন্দ্র ও প্রতিরোধের অস্ত্র হিসাবে আমার হাতে ‘আংশিক ইচ্ছাশক্তি’ ছাড়া আর কিছুই নাই।
মানুষের জন্য একমাত্র অস্ত্র এই 'আংশিক ইচ্ছাশক্তির' জন্য সেই সব অসংখ্য শত্রু ও অগণিত ক্ষতিকর বস্তুসমূহের বিপরীতে চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। তার পক্ষে অতীতে ক্রিয়াশীল হওয়া সম্ভব নয় যার মাধ্যমে সে অতীত থেকে আসা দুঃখ-যন্ত্রণা থামিয়ে দিতে পারে। আর ভবিষ্যতে ক্রিয়াশীল হওয়াও সম্ভব নয় যাতে সে ভবিষ্যৎ থেকে আসা ভয়-ভীতিকে বাধা দিতে পারে।
তারপর আমি দেখতে পেলাম অতীত ও ভবিষ্যতের দিকে প্রত্যবর্তনকারী আমার আশা ও বেদনাসমূহ কোন উপকার বা ফলাফল নেই।
এই ছয় দিক থেকে আসা বিভীষিকা ও ভয়াবহতা এবং অন্ধকার দূর করল কুরআন মজীদের উজ্জ্বল ঈমানী নূর। এই ঈমনী নূর ঐ ছয় দিককে এতটাই আলোকিত ও উজ্জ্বল করেছে যে, যদি একাকিত্ব ও অন্ধকার একশ গুণ বেশীও হয় তবে ঐ নূর যথেষ্ট ও পরিপূর্ণ। সমস্ত বিভিীষিকাকে একে একে সান্তনায় পরিণত করে এবং সমস্ত একাকিত্বকে একের পর এক হৃদ্যতায় রূপান্তরিত করে।
এই বার্ধক্যেও আশার আলো দেখতে পেয়েছি । পেয়েছি বার্ধক্যে সান্তনার আলো। মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া তিনি আমাকে আমার যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী দিয়েছেন আশ এবং আলো।
বার্ধক্য নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। মহান আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া তিনি আমাকে দীর্ঘ জীবন দিয়েছেন। তিনি রাহমানুর রাহীম। তাঁর নেয়ামত এবং রহমত এই বার্ধেক্যে সবচেয়ে বড় আশা ও আলো।
আমাকে যারা জন্মদিনের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তাদের সবার জন্য দোয়া। মহান আল্লাহ সবাইকে রহমত ও বরকত দান করুন।
লক্ষ-কোটি দরূদ ও সালাম আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্ম (সঃ) এর উপর।
আমীন।