সূরা তাওবা, রুকু -১৪, আল্লাহর সাথে মুমিনদের ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি।

 কুরআন পড়ুন, বুঝে পড়ুন 

নিজে জানুন, অন্যকে বলুন




দয়াময়, পরম দয়ালু আল্রাহর নামে শুরু।

রুকু ১৪।

আয়াত ১১১ - ১১৮

আল্লাহর সাথে মুমিনদের ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি। 


আলেচ্য মূল বিষয়:

  1. মুজাহিদদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত ও দয়া। 

  2. মুমিনদের জন্য শুভসংবাদ।

  3. ইমান হচ্ছে সব সম্পর্কের ভিত্তি

  4. মুমিনদের প্রতি সান্তনাবাণী ও আল্লাহর সিফাত বর্ণনা। 

  5. সত্যিকারের তওবাকারীর তওবা আল্লাহর কাছে গৃহীত।


আয়াত অনুযায়ী আলোচ্য বিষয়:

১১১ নং আয়াত : মুজাহিদদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত ও দয়া। 

-------------------------------------------------------------------------------------

(১১১) নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের নিকট  হইতে  তাহাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করিয়া লইয়াছেন, তাহাদের জন্য জান্নাত আছে ইহার বিনিময়ে। তাহারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, নিধন করে ও নিহত হয়।তাওরাত, ইন্জীল ও কুরআন এই সম্পর্কে তাহাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি রহিয়াছে। নিজ প্রতিজ্ঞা পালনে আল্লাহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর কে আছে? তোমরা যে সওদা করিয়াছ সেই সওদার জন্য আনন্দিত হও এবং উহাই তো মহাসাফল্য)  

-------------------------------------------------------------------------------------

  • মুজাহিদরা তাদের প্রাণ এবং সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে। 

  • এর বিনিময়ে আল্লাহ তাদের জান্নাত দান করেন। 

  •  আল্লাহ কিসের অঙ্গীকার করেছেন?

- আল্লাহ অংগীকার করেছেন যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, বিপক্ষকে  নিধন করে এবং কোন সময় নিজেরাই নিহত হয় - তাদের বেহেশত দানের অঙ্গীকার করেছেন।

- শুধূ কুরআন নয় তাওরাত, ইঞ্জিল শরীফেও আল্লাহ অঙ্গীকার করেছেন। 

- আল্লাহ অঙ্গীকার পালনে শ্রেষ্ঠতর।  

  • মহাসফল্যকারী কে? 

  1. যাদের জান ও মাল আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। 


১১২ নং আয়াত: মুমিনদের জন্য শুভ সংবাদ । 

-------------------------------------------------------------------------------------

(১১২) উহারা তওবাকারী, ইবাদতকারী, আল্লাহর প্রশংসাকারী, সিয়াম পালনকারী, রুকুকারী, সিজদাদানকারী, সত্‌কাজের নির্দেশদাতা, অসত্‌কাজে নিষেধকারী এবং আল্লাহর নির্ধরিত সীমারেখা সংরক্ষণকারী; এই মুমিনদের তুমি শুভ সংবাদ দাও। 

------------------------------------------------------------------------------------


  • মুমিনদের কর্তব্য কাজ: 

  1. তারা গুণাহ ও অশ্লীলতা থেকে তওবা করে। 

  2. আল্লাহর ইবাদত করে।

  3. আল্লাহর প্রশংসা বর্ণনা করে।

  4. সিয়াম পালন করে। 

  5. সালাতে রুকু ও সিজদা করে ।

  6. সত্‌কাজে আদেশ দান করে। 

  7. মন্দ কাজে বাধা দান করে।

  8. আল্লাহর বিধানসমূহের নির্ধারিত সীমারেখা মেনে চলে।   



১১৩ ও ১১৪ নং আয়াত: ইমান হচ্ছে সব সম্পর্কের ভিত্তি

-------------------------------------------------------------------------------------

(১১৩) আত্মীয়-স্বজন হইলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং মুমিনদের জন্য সংগত নয় যখন ইহা সুস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে যে, নিশ্চিতই উহারা জাহান্নামী। 

-------------------------------------------------------------------------------------

(১১৪) ইব্রাহীম তাহার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছিল, তাহাকে ইহার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল বলিয়া; অতঃপর যখন ইহা তাহার নিকট সুস্পষ্ট হইল যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন ইব্রাহীম উহার সম্পর্ক ছিন্ন করিল। ইব্রাহীম তো কোমল হৃদয় ও সহনশীল। 

-------------------------------------------------------------------------------------

  • মানুষের সাথে সম্পর্কের এক অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে ইমান। আত্মীয় হলেই হবে না। 

  • দু শ্রেণীর মৃত ব্যক্তির জানাযা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

  1. যে সব ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করে ইসলাম গ্রহণ না করে  এবং নিজের পাপের জন্য অনুতাপ না করে। 

  2. যারা সক্রিয়ভাবে ইসলাম প্রসারে বাঁধা সৃষ্টি করে।

  3. তারা আত্মীয়-স্বজন হলেও করা যাবে না; কারণ তারা জাহান্নামী।  

  • মহান আল্লাহ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর পিতার উদাহরণ দিয়েছেন। 

  • হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর পিতার মৃত্যুর পর মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেছিলেন, কিন্তু মহান আল্লাহ তা কবুল করেন নি।   




১১৫ ও ১১৬ নং আয়াত: মুমিনদের প্রতি সান্তনাবাণী ও আল্লাহর সিফাত বর্ণনা। 

-------------------------------------------------------------------------------------

(১১৫) আল্লাহ এমন নন যে, তিনি কোন সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করিবার পর উহাদেরকে বিভ্রান্ত করিবেন। উহাদের কি বিষয়ে তাকওয়া অবলম্বন করিতে হইবে, ইহা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত ন করা পর্যন্ত; নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে অবহিত।

-------------------------------------------------------------------------------------

(১১৬) আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌম ক্ষমতা আল্লাহরই; তিনি জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান। আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন অভিভাবক নাই, সাহায্যকারী নাই। 

------------------------------------------------------------------------------ 

  • আল্লাহ কাউকে সত্‌পথ প্রদর্শনের পর পুনরায় তাকে পথভ্রষ্ট করা আল্লাহর রীতি নয়। 

  • কোন কোন বিষয়ে তাকওয়া বা সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে তা আল্লাহ স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন। 

  • না জানিয়ে কাউকে আল্লাহ অভিযুক্ত করেন না। 

  • কে আল্লাহর দেখান সত্‌পথ সম্পর্কে জ্ঞাত এবং কে অনবহিত তা আল্লাহ ভাল করেই জানেন। 

  • আল্রাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী 

  • তিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। 

  • আল্লাহ ব্যতীত আর কোন অভিভাবক ও সাহায়্যকারী নেই। 



১১৭ ও ১১৮ নং আয়াত: সত্যিকারের তওবাকারীর তওবা আল্লাহর কাছে গৃহীত।

-------------------------------------------------------------------------------------

(১১৭) আল্লাহ অবশ্যই অনুগ্রহপরায়ণ হইলেন নবীর প্রতি এবং মুহাজির ও আনসারদের প্রতি যাহারা তাহার অনুসরণ করিয়াছিল সংকটকালে - এমনকি যখন তাহাদের একদলের চিত্ত-বৈকল্যের উপক্রম হইয়াছিল। পরে আল্লাহ উহাদেরকে ক্ষমা করিলেন; তিনি তো উহাদের প্রতি দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু। 

-------------------------------------------------------------------------------------

(১১৮) এবং তিনি ক্ষমা করিলেন অপর তিনজনকেও,যাহাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হইয়াছিল, যে পর্যন্ত না পৃথিবী বিস্তৃত হওয়া সত্বেও তাহাদের জন্য ইহা সংকুচিত হইয়াছিল এবং তাহাদের জীবন তাহাদের জন্য দুর্বিষহ হইয়াছিল এবং তাহারা উপলব্ধি করিয়াছিল যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন আশ্রয়স্থল নাই, তাঁহার দিকে প্রত্যাবর্তন ব্যতীত, পরে তিনি উহাদের তওবা কবুল করিলেন যাহাতে উহারা তওবায় স্থির থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।   

------------------------------------------------------------------------------

কিছু মুহাজির এর্ব আনসাররা তাবুক অভিযানের সময় যুদ্ধে না যাবার জন্য রাসুল (সঃ) এর কাছে অব্যাহতি প্রার্থনা করে এবং তিনি তা মঞ্জুর করেন। ফলে আল্লাহও তাদের ক্ষমা করে দেয়। সাহাবীরা ছিলেন হযরত আবু লুবাবা, হযরত কাব বিন মালেক, হযরত মারারা বিন রাবীয়া এবং হজরত হেলাল বিন উমাইয়া । 

  • মানবিক দুর্বলতার কারণে যুদ্ধে যেতে কয়েকজন দ্বিধা প্রকাশ করে এবং পরে ক্ষমা প্রার্থনা করে। 

  • নবী (সঃ) তাদের বিষয়ে আল্লাহকে সোপর্দ করেন। 

  • আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন। 

  • কারণ আল্লাহ দয়ার্দ্র এবং পরম করুণাময়। 

  • কয়েকজন যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য অনুতাপকারীর অনুতাপজনিত অবস্থায় মনে হয়েছিল এ বিশাল পৃথিবী অত্যন্ত সংকুচিত এবং দুর্বিষহ। 

  • তারা উপলব্ধি করেছিল আল্লাহ ছাড়া তাদের আর কোন আশ্রয়স্থল  নেই। 

  • বিশ্বাসীদের প্রতি আল্লাহর দয়ার সীমা নাই। 




অনুধাবন: 

  •  আল্লাহ যে অঙ্গীকার করেন তা পলন করেন। আল্লাহ আল্লাহর পথে সংগ্রামকারীদের জান্নাত দানের অঙ্গীকার করেছেন। 

  • মহান আল্লাহ নিজেই আমাদের জীবন ও সম্পদ দান করেছেন আবার জান্নাতের বিনিময়ে তা তিনি ক্রয় করছেন। যারা আল্লাহর সাথে এভাবে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে তারাই মহাফলতা পাবে। 

  •  আকীদা ও বিশ্বাস হচ্ছে মানুষের সাথে আরেক মানুষের সম্পর্ক নির্ণয়ে মূল বিষয়।

  •  আধ্যত্মিক জীবন হচ্ছে স্থায়ী জীবনের ঠিকানা। পার্থিব জীবনের নিকট বন্ধন ক্ষণস্থায়ী। এই পৃথিবীতে আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে পরস্পর বিরোধী হয় তবে মৃত্যুর পর সে বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়।  

  • আত্মীয় যদি মুশরিক হয় তার প্রতি যতই অনুরাগ থাকুক না কেন ক্ষমা প্রার্থনা করা যাবে না। 

  • মানুষের অভিভাবক ও সাহায্যকারী হিসাবে আল্লাহ যথেষ্ট। 

  • সাধারণ মানুষের দুর্বলতা ও ভুল মহান আল্লাহ ক্ষমা  করে নেন যদি সে তার ভুল সংশোধন করে। 

  • আমাদের মনে রাখতে হবে জীবন ও তার আরাম-আয়েশ ভোগ করা থেকে কর্তব্য কর্ম করা অনেক বড় কাজ। 



সংক্ষিপ্ত:
 

(ক) মহান আল্লাহ  এবং  মুমিন ব্যক্তির মধ্যে কুরআনের ভাষায় পারস্পরিক বেচাকেনার চুক্তি করেছেন। এই  চুক্তির প্রকৃতি: (১১১) 

  • ক্রেতা - মহান আল্লাহ, বিক্রেতা - মুমিন বান্দা।

  • ব্যবসার পণ্য : মুমিনদের জান-মাল যা আল্রাহ নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছেন। 

  • যেহেতু আল্লহর সাথে বেচাকেনার চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে ক্রেতা আল্লাহ যেভাবে চাইবেন সেভাবে মাল ব্যবহার করতে হবে। 

  • সাধারণত বিক্রীত সম্পদ ক্রেতার সম্পদে পরিণত হয়। 

  • বিক্রেতার লাভ: বিক্রেতা মুমিন চুক্তি মেনে চললে ক্রেতা আল্লাহর কাছ থেকে জান্নাত পাবে। 

  • চুক্তি বািস্তবায়নের পদ্ধতি: বিক্রেতা মুমিন তার জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম, নিধন অথবা নিহত হয়ে।  

  • গ্যরাণ্টি : আল্লাহর ওয়াদা। এটা তাঁর পাকা ওয়াদা এবং যার প্রতিপালন তিনি অবশ্যই করবেন। 

  • ব্যবসায়িক সাক্ষী - তাওরাত, ইঞ্জীল এবং কুরআনে। 


(খ) সত্যিকার ক্রেতা বা মুমিনের পরিচয়: (১১২)

  • তারা অনুতাপের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে ফিরে যায়। 

  • আল্লাহর আনুগত্য করে।

  • আল্লাহর প্রশংসা বর্ণনা করে।

  • একান্ত আনুগত্যের সাথে আল্লাহর রাস্তায় পর্যটন করে।

  • সালাতে রুকু ও সিজদা করে ।

  • ভাল কাজে আদেশ দান করে। 

  • মন্দ কাজে বাধা দান করে।

  • আল্লাহর বিধানসমূহের নির্ধারিত সীমারেখা মেনে চলে।   


(গ) নৈতিক নীতিমালা: (১১৩ - ১১৮)

  • মানুষের মধ্যে সম্পর্কের মূল ভিত্তি হচ্ছে ঈমান।

  • মৃত মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা যাবে না। 

  • গুনাহ মাফ চাওয়ার ব্যাপারে রক্তের সম্পর্কের কোন স্থান নেই।

  • আল্লাহ সাধারণত কাউকে সৎ পথ প্রদর্শন করলে পথভ্রষ্ট করেন না। 

  • আল্লাহর প্রবর্তিত বিধান জানার পর তা লংঘন করলে শাস্তি পাবে। 

  • কে জ্ঞাতসারে এবং কে অজ্ঞাতসারে বিধান লংঘন করে আল্লাহ তা ভাল করেই জানেন। 

  • মুমিনকে মনে রাখতে হবে তার অভিভাবক এবং সাহায্যকারী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট।

  • আইনের প্রয়োগ করতে হবে কঠোরভাবে। 

  • কর্তব্য কঠিন বা অপ্রীতিকর যাই হাক না কেন তা অবশ্যই করণীয় কর্তব্য থেকে রেহাই পাবার চিন্তা করা উচিত না।   




Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url