সূরা তাওবা। রুকু-৪। আরবে ইসলামের জয়জয়কার।
কুরআন পড়ুন, বুঝে পড়ুন
নিজে জানুন, অন্যকে বলুন।
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু
সূরা তাওবা । রুকু -৪
আয়াত: ২৫ - ২৯
আরবে ইসলামের জয়জয়কার।
আয়াত অনুযায়ী আলোচ্য বিষয়:
—-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(২৫) আল্লাহ তোমাদেরকে তো সাহায্য করিয়াছেন বহু ক্ষেত্রে এবং হুনায়নের যুদ্ধের দিনে যখন তোমদেরকে উৎফুল্ল করিয়াছিল তোমাদের সংখ্যাধিক্য; কিন্তু উহা তোমাদের কোন কাজে আসে নাই এবং বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবী তোমাদের জন্য সংকুচিত হইয়াছিল, পরে তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিয়া পলায়ন করিয়াছিলে।
—-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
- মহান আল্লাহ মুসলমানদের বহু ক্ষেত্রে বিশেষ করে হুনায়ুনের যুদ্ধে যে দয়া ও দান করেছেন তা উল্লেখ করেছেন
- মুসলমানরা তাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে জয়লাভ নিশ্চিত বলে উৎফুল্ল ছিল।
- তাদের মনের অহংকার গর্ব প্রধান্য দেয়।
- তারা ভুলে যায় যে, বিজয় কখনো সংখ্যাধ্যিকের উপর নির্ভর করে না করে আল্লাহর সাহায্যের উপর।
- বাস্তবে যুদ্ধ ক্ষেত্রে সংখ্যাধিক্য তা কোন কাজে আসে নি।
- প্রতিপক্ষের সংঘবদ্ধ আক্রমণে বিশাল পৃথিবী তাদের কাছে সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল।
- ফলে মুসলমান সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়েছিল।
বি.দ্র: মক্কার ১৪ মাইল পূর্বে, পর্বতময় মক্কা এবং তায়েফের উপত্যাকার মধ্যবর্তী স্থানে পর্বতময় হুনায়ুনের অবস্থান।
২৬ নং আয়াত: আল্লাহর দয়া।
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(২৬) অতঃপর আল্লাহ তাঁহার নিকট হইতে তাঁহার রাসুল ও মুমিনদের উপর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং এমন এক সৈন্যবাহিনী অবতীর্ণ করেন যাহা তোমরা দেখিতে পাও নাই এবং কাফিরদেরকে শাস্তি প্রদান করেন; ইহাই কাফিরদের কর্মফল।
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আল্লাহ তাঁর রাসুল ও মুমিনদের উপর প্রশান্তি (সাকিনা ) বর্ষন করেন।
আল্লাহ আরো প্রেরণ করেন অদৃশ্য সাহায্যকারীর দল।
দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সাহায্যকারীর সাহায্যে মুসলমানরা বিজয়ী হয়েছিল।
কাফিরদের তাদের কর্মের জন্য শাস্তি প্রদান করেন।
২৭ নং আয়াত: তাওবার সুযোগ।
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(২৭) ইহার পরও যাহার প্রতি ইচ্ছা আল্লাহ ক্ষমাপরায়ণ হইবেন; আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছিল তাদের অনেকেই তাওবা করার তৌফিক লাভ করেছিল।
আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
২৮ নং আয়াত: শেরেক কারীরা পবিত্র নয়।
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(২৮) হে মুমিণগণ! মুশরিকরা তো অপবিত্র; সুতরাং এই বৎসরের পর তাহারা যেন মসজিদুল হারামের নিকট না আসে। যদি তোমরা দারিদ্রের আশঙ্কা কর তবে আল্লাহ ইচ্ছা করিলে তাঁহার নিজ করুণায় তোমাদেরকে অভাবমুক্ত করিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
মুশরিকদের অপবিত্র ঘোষণা করেছেন।
এই অপবিত্রতা এই নয় যে, তাদের শরীরটা নাপাক; তাদের বিশ্বাসগত অপবিত্রতা বোঝানো হয়েছে , যা তাদের সমগ্র সত্তায় বিস্তার লাভ করেছে।
তাদের মসজিদুল হারামের কাছে আসা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
মুশরিকদের আসতে না দিলে মক্কার মুসলমানরা ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির উপর মন্দ প্রভাবের আশংকা করা হয়। তার জন্য চিন্তিত হতে নিষেধ করেছেন।
অভাবমুক্ত হবার জন্য আল্লাহর উপর আস্থা রাখতে বলা হয়েছে।
কারণ আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
২৯ নং আয়াত: কিতাবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(২৯) যাহাদের প্রতি কিতাব অবতীর্ণ হইয়াছে তাহাদের মধ্যে যাহারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না, শেষদিনেও নয় এবং আল্লাহ ও তাঁহার রাসুল যাহা হারাম করিয়াছেন তাহা হারাম গণ্য করে না, তাহাদের সঙ্গে যুদ্ধ করিবে, যে পর্যন্ত না তাহারা নত হইয়া স্বহস্তে জিযিয়া দেয়।
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যাদের সাথে যুদ্ধ করা নির্দেশ ।
যাদের উপর কিতাব নাযিল হয়েছে কিন্তু তারা
(ক) আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না।
(খ) শেষ দিনে বিশ্বাস করে না।
(গ) আল্লাহ যে সব বস্তুকে হারাম ঘোষণা করেছেন তাকে হারাম বলে গণ্য করে না।
যুদ্ধের সময়সীমা।
(ক) যতক্ষণ পর্যন্ত শত্রুপক্ষ পরাজিত (সগিরুন) না হয়।
(খ) স্বহস্তে জিযিয়া কর দেয়।
বি. দ্র: জিযিয়া’ এক ধরণের কর। মুসলিম রাষ্ট্রের যুদ্ধক্ষম অমুসলিমের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয়।
আমরা মুসলমানরা বিশ্বাস করি ইসলাম শান্তির ধর্ম। কিন্তু যে সব ব্যক্তিার প্রমাণ করতে চায় ইসলাম আসলে যুদ্ধের ধর্ম, সন্ত্রাসের ধর্ম। তার মধ্যে কুরআনের যে আয়াতগুলোকে রেফারেন্স হিসাবে ধরে তার মধ্যে সূরা তাওবার ২৯ নং আয়াত অন্যতম।
"তোমরা জিহাদ কর আহলে-কিতাবের ঐ লোকদের সঙ্গে, যারা আল্লাহ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যা হারাম করেে দিয়েছেন তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য ধর্ম। যতক্ষণ না করজোড়ে তারা জিযিয়া প্রদান করে।"
এই আয়াতটি দিয়ে তারা বোঝাতে চেষ্টা করে ইসলাম ধর্ম এমন একটি ধর্ম যা জোরদবস্তি করে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করে।পৃথিবীতে যতক্ষণ ইহুদী ও খ্রিষ্টানরা আছে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হবে। যতক্ষণ না তারা মুসলিম না হয় ততক্ষণ অপমানজনক জিযিয়া কর দিতে হবে।
কুরআনের বিভিন্ন আয়াত দিয়ে বোঝানো হয়েছে ইসলামে ধর্মের ব্যাপারে জোর-জবরদস্তি নয়।
যেমন::
সূরা বাকারা ১৯০ নং আয়াতে আল্লাহ এরশাদ করেছেন "আর লড়াই কর আল্লাহর নিমিত্তে তাদের সাথে, যারা লড়াই করে তোমাদের সাথে। অবশ্য কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারীকে পছন্দ করেন না।"
সূরা বাকারা :২৫৬ আয়াত দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্যবাধকতা নেই।
সূরা মুমতাহিনাে ৮ ও ৯ আয়াত : ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না।আল্লাহ নিশ্চয়ই ইনসাফকারীকে ভালবাসেন। আল্লাহ কেবল তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করেছে এবং বহিস্কারার্থে সহায়তা করেছে। "
এরকম কুরআনে আরা আয়াত আছে যেখানে পরিষ্কার করে বলে দেয়া আছে জোর জবরদস্তি করে ধর্ম চাপিয়ে দেয়া যাবে না। এসব আয়াতের সাপেক্ষে ২৯ নং আয়াতটি অন্যরকম। যেখানে বলা হয়েছে আহলে কিতাবীরা ইসলাম গ্রহণ না করা পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হবে। আর না হয়ে নত বা অপমানিত হয়ে মুক্তিপণ দিয়ে জীবন বাঁচাতে হবে।
আরা যদি এভাবে দেখি তবে ইসলাম ধর্মকে নিষ্ঠর মনে হতে পারে। কিন্ত এর কনটেক্সটা জানতে হবে।
সেই সময় আরবের উত্তরে খ্রিস্টান সম্প্রদায় বসবাস করত। মহানবী (সঃ) সেখানে ইসলাম প্রচারের জন্য দূত পাঠিয়েছিলেন । ১৫ জন দূতকে হত্যা করা হয় এবং একজন দূত কোনরকমে পালিয়ে আসেন। সেই সময় খ্রিস্টানরা রোমানদেরকে তাদের পক্ষে যুদ্ধ করার আহ্বান জানান। সিজারের নেতৃত্বে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে তারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হন যা মুতার যুদ্ধ নামে পরিচিত। পরবর্তী পর্যায়ে রোমানদের এক কমান্ডার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে । সিজারের সৈন্যরা তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং ইসলাম ত্যাগ না করায় তাকে হত্যা করা হয়।
মুতার যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার জন্য পরবর্তীতে সিজার প্রস্তুতি নেয় যুদ্ধ করার জন্য। ইসলাম রক্ষায় এই যুদ্ধের অনেক গুরুত্ব ছিল। এই যুদ্ধের প্রিপারেশনে সাহাবীরা অনেক ধন-সম্পদ দিয়ে সহায়তা করেন। এই তাবুকের যুদ্ধে হজার হাজার মুসলমান একত্রিত হন এবং নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতে তারা তৈরী ছিলেন। মহানবী (সঃ) এর নেতৃত্বে তাবুকে উপস্থিত হন। সুতার যুদ্ধে পরাজয়ের কথা মনে করে সিজার যুদ্ধ না করে দেশে ফেরত চলে যান। এই তাবুক যুদ্ধের সময় এই ২৯ নং আয়াতটি নাযিল হয়। ওখানকার আশেপাশে যে খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকা ছিল সেখানে মুসলিম আধিপত্য বিস্তার করতে এই আয়াতটি নাযিল হয়।যাতে রোমানরা অতর্কিতে আক্রমণ করতে না পারে। ওই খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকা গুলো রোমানদের কর দিত। সেই হিসাবে রোমানদের বদলে মুসলমানদের কর দেবার নিয়ম চালু হয়।রোমানদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য মুসলিমরা দায় বদ্ধ। এরপর যে সব এলাকায় ইসলাম গ্রহণ করে সেখান থেকে জিযিয়া কর উঠিয়ে নেয়া হয়।
অনুধাবন:
যুদ্ধে বিজয় শুধু সংখ্যাধিক্যের উপর নির্ভর করে না করে আল্লাহর সাহায্যর উপর।
আল্লাহ যদি মানুষের মনে প্রশান্তি (সাকিনা) দেন তবে তার অন্তরে যে আতংক সৃষ্টি হয় তা আর থাকে না।
বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর করুণা ও দয়া সর্বদা প্রবাহিত।
মহান আল্লাহ মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জিযিয়া কর আদায় করতে বলেছেন। জোর করে মুসলিম বানাতে বলেন নি। কারণ বিশ্বাস মানুষের মনের সাথে সম্পৃক্ত । জোর করে মন জয় করা যায় না।