সূরা বাকারা । রুকু - ৩২ । সত্যর জন্য যুদ্ধ।
কুরআন পড়ুন, বুঝে পড়ুন
নিজে জানুন, অন্যকে বলুন
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু।
সূরা বাকারা। রুকু - ৩২।
আয়াত -২৪৩ -২৪৮
সত্যর জন্য যুদ্ধ।
------------------------------------------------------------------------------
(২৪৩) তুমি কি তাহাদের দেখ নাই যাহারা মৃত্যুভয়ে হাজারে হাজারে স্বীয় মাতৃভূমি পরিত্যাগ করিয়াছিল? অতঃপর আল্লাহ তাহাদেরকে বলিয়াছিলেন, 'তোমাদের মৃত্যু হউক।' তারপর আল্লাহ তাহাদের জীবিত করিয়াছিলেন। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অনুগ্রহশীল; কিন্তু অধিকাংশ লোকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।
------------------------------------------------------------------------------
মৃত্যুভয়ে মানুষ নিজের মাতৃভূমি পরিত্যাগ করে।
কিন্তু তাদের সে প্রচেষ্টা কাজে আসেনি।
আল্লাহ যখন চেয়েছেন তখনই তাদের মৃত্যু হয়েছে।
আল্লাহ মানুষের জীবন ও সম্পদ দিয়েছেন এবং তিনি যে কোন মুহূর্তে তা ছিনিয়ে নিতে সক্ষম।
আল্লাহ মানুষের প্রতি অনুগ্রহশীল।
বেশীরভাগ মানুষ আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।
২৪৪ নং আয়াত: জেহাদে উৎসাহ প্রদান।
------------------------------------------------------------------------------
(২৪৪) তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর এবং জানিয়া রাখ যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
------------------------------------------------------------------------------
আল্লাহর আইনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জেহাদ করতে হবে।
আল্লাহ জিহাদ ফরয করে দিয়েছেন।
আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
২৪৫ নং আয়াত: জেহাদ ও সৎ কাজে ব্যয় করতে উৎসাহ প্রদান।
------------------------------------------------------------------------------
(২৪৫) কে সে, যে আল্লাহকে করযে হাসানা প্রদান করিবে? তিনি তাহার জন্য ইহা বহুগুণে বৃদ্ধি করিবেন। আর আল্লাহ সংকুচিত ও সম্প্রসারিত করেন এবং তাঁর পানেই তোমরা প্রত্যানীত হইবে।
------------------------------------------------------------------------------
মহান আল্লাহ আল্লাহর রাস্তা কিংবা সৎ কাজে ব্যয় করাকে রূপক অর্থে 'করযে হাসানা অর্থ্যাত্ উত্তম ঋণ' হিসাবে অভিহিত করেছেন।
এর বিনিময় দেয়া হবে 'সওয়াব' রূপে।
এই আয়াতে সংকুচিত এবং সম্প্রসারিত কথাটির অর্থ রিজিকের সংকোচন ও প্রসারণ।
মহান আল্লাহ মানুষকে অভাব ও প্রাচুর্য দেন।
মানুষকে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে।
এর পরবর্তী আয়াতগুলিতে তালুত ও জালুতের ঘটনা বলা হয়েছে।
বনী ইসরাঈলীরা হযরত মূসা (আঃ) এর মৃত্যুর পর আল্লাহর বিধিনিষেধকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের ইচ্ছামত জীবন পরিচালিত করে। তাদের উপর আমালেকা সম্প্রদায়ের লোকেরা অনেক অত্যাচার করত। তখন তাদের মনে নিজেদের সংশোধনের চিন্তা করে এবং তখনকার নবী হযরত সামুয়েল (আঃ) এর কাছে তারা যায়। তারা নবীর কাছে তাদের জন্য একজন রাজা নির্বাচন করে দিতে বলেন। এটা হযরত মূসা (আঃ) এর মৃত্যুর প্রায় সাড়ে তিনশত বছর পরের ঘটনা। হযরত মূসা (আঃ) ফিরাউন এর কাছ থেকে ইহুদী সম্প্রদায়কে মুক্ত করার পরে তাদের দেশ ফিলিস্তিনকে আমালেকা সম্প্রদায়ের হাত থেকে রক্ষা করতে যুদ্ধ করতে আহ্বান জানান। কিন্তু তারা যুদ্ধ করতে অস্বীকার করে। পরবর্তীতে হযরত ইউশা (আঃ) এর নেতৃত্বে ফিলিস্তিন রাজ্য জয় করে এবং সেখানে ফিরে এসে বসবাস করতে থাকে। তাদের মধ্যে কোন একতা ছিল না এবং তাদের কোন শাসনকর্তা ছিল না। তাদের শাসনকর্তা এবং সংঘবদ্ধ না থাকায় আশেপাশের বিভিন্ন জাতি তাদের উপর হামলা চালাত। সবশেষে ফিলিস্তিনের পৌত্তলিক সম্প্রদায় তাদের পর্যুদুস্ত করে তাদের বরকতপূর্ণ সিন্দুক লুট করে নিয়ে যায়। এই সিন্দুকের ভিতর ছিল আল্লাহ প্রদত্ত প্রশান্তির উপকরণ (আল্লাহ প্রদত্ত তাওরাতের কপি ও ‘মান্না’র নমুনা) এবং হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত হারুন (আঃ) এর কিছু বরকতময় জিনিস। ।
তারা তৎকালীন নবী হযরত সামুয়েল (আঃ) এর কাছে যায় এবং তাদের একজন সম্রাট নির্বাচন করে দিতে বলেন। কথিত আছে তিনি আল্লাহর কাছে সম্রাটের জন্য প্রার্থনা করেন। তাকে একটি লাঠি ও একটি তেল ভর্তি পাত্র দেয়া হয়। প্রত্যাদেশের মাধ্যমে তাকে জানিয়ে দেয়া হয় - একটি লোক আসবে যার শরীর হবে এই লাঠির সমান লম্বা আর তেলের পাত্রে তরঙ্গ সৃষ্টি হবে। সেই আগন্তকের মাথায় তেল মালিশ করে দিয়ে তাঁকে সম্রাট নিযুক্ত করতে বলা হয়। সে অনুযায়ী তিনি ‘তালুতকে তাদের নেতা নির্বাচন করে দেন। বনী ঈসরাঈলীরা তাঁকে সম্রাট হিসেবে মানতে অস্বীকার করে । কারণ তারা মনে করে তাদের সম্রাট তাদের বংশ থেকে হবে। কিন্তু তালুত ছিল অন্য বংশের এবং দরিদ্র। তার কোন ঐশ্বর্য বা সম্পদ নেই। তারা আল্লাহ যে তালুতকে মনোনীত করেছেন তার নিদর্শন দাবী করে। নবী (আঃ) বলেন, তালুত যে বাদশাহ তার নিদর্শন হচ্ছে সিন্দুকটি ফেরৎ আসবে। ফিরিশতারা এটা বহন করে নিয়ে আসবে। তাছাড়া তালুত ছিলেন জ্ঞান ও শারিরীক সৌষ্ঠবের অধিকারী। মহান আল্লাহ তাঁকে সম্রাট নিযুক্ত করেছেন এবং সে সাথে তাঁকে দিয়েছেন জ্ঞান ও দেহ। মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের দ্বারা সেই সিন্দুক তালুতের দরজায় পৌঁছিয়ে দেন। । বনী ঈসরাঈলার এই অলৌকিক নিদর্শনকে আনন্দের সাথে তালুতের রাজত্বের প্রমাণ হিসাবে মেনে নেয়।এছাড়াও আল্লাহ সিন্দুকটিকে তাদের মনের প্রশান্তির উপকরণ করেন। এখানে মনে হয় মনের প্রশানিতর উপকরণ অর্থ আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের উপর আল্লাহর রহমত ও বিশেষ সাহায্য করেন। তাদের অন্তর শত্রুর ভয়ে ভীত থাকে না এবং বিজয় ও সফলতার আশায় পরিপূর্ণ থাকে।
২৪৬ ও ২৪৭ নং আয়াত: তালুত ও জালুতের ঘটনা।
------------------------------------------------------------------------------
(২৪৬) তুমি কি মূসার পরবর্তী বনী ইসরাঈল প্রধানদেরকে দেখ নাই? তাহারা যখন তাহাদের নবীকে বলিয়াছিল, 'আমাদের জন্য এক রাজা নিযুক্ত কর যাহাতে আমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে পারি।' সে বলিল, 'ইহা তো হইবে না যে, তোমাদের প্রতি যুদ্ধের বিধান দেওয়া হইল তখন আর তোমরা যুদ্ধ করিবে না? তাারা বলিল, 'আমরা যখন স্ব স্ব আবাসভূমি ও স্বীয় সন্তান-সন্ততি হইতে বহিস্কৃত হইয়াছি, তখন আল্লাহর পথে কেন যুদ্ধ করিব না? অতঃপর যখন তাহাদের প্রতি যুদ্ধের বিধান দেওয়া হইল তখন তাহারা অল্প সংখ্যক ব্যতীত সকলেই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিল। এবং আল্লাহ জালিমদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।
------------------------------------------------------------------------------
(২৪৭) আর তাহাদের নবী তাহাদের বলিয়াছিল, আল্লাহ অবশ্যই তালূতকে তোমাদের রাজা করিয়াছেন। তাহারা বলিল, 'আমাদের উপর তাহাদের রাজত্ব কিরূপে হইেব, যখন আমরা তাহা অপেক্ষা রাজত্বের অধিক হকদার এবং তাহাকে প্রচুর ঐশ্বর্য দেওয়া হয় নাই। নবী বলিল, 'আল্লাহ অবশ্যই তাহাকে তোমাদের জন্য মনোনীত করিয়াছেন এবং তিনি তাহাকে জ্ঞানে ও দেহে সমৃদ্ধ করিয়াছেন।' আল্লাহ যাকে ইচ্ছা স্বীয় রাজত্ব দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, প্রজ্ঞাময়।
------------------------------------------------------------------------------
(২৪৮) আর তাহাদের নবী তাহাদের বলিয়াছিল, 'তাহার রাজত্বের নিদর্শন এই যে, তোমাদের নিকট সেই সিন্দুক (তাবূত) আসিবে যাহাতে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে চিত্ত-প্রশান্তি এবং মূসা ও হারুন-বংশীয়গণ যাহা পরিত্যাগ করিয়াছে তাহার অবশিষ্টাংশ থাকিবে; ফিরিশতাগণ ইহা বহন করিয়া আনিবে। তোমরা যদি মুমিন হও তবে অবশ্যই তোমাদের জন্য ইহাতে নিদর্শন আছে।
------------------------------------------------------------------------------
অনুধাবন:
জীবন ও মৃত্যুর মালিক একমাত্র আল্লাহ । জীবন ও ধনসম্পদ আল্লাহই দিয়েছেন এবং যে কোন সময় তিনি তা ছিনিয়ে নিতে সক্ষম।
মহান আল্লাহ এই ঘটনা তুলে ধরে ঈমানদারদের সম্পদ ও জীবন আল্লাহর পথে উত্সর্গ করতে উত্সাহিত করে।
বেশীর ভাগ মানুষ আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ।
আল্লাহ সবকিছু শোনেন এবং জানেন। তিনি আমাদের সব কাজ, কথা, চিন্ত-ভাবনা সম্পর্কে অবহিত। আমাদের অন্তরের খবর মানুষের কাছে গোপন রাখতে পারি কিন্তু আল্লাহর কাছে নয়।
আল্লাহকে খুশী করার মানসে আমাদের সৎকাজ এবং জিহাদে খরচ করতে হবে। এর থেকে মানুষ নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণা লাভ করে।
মানুষকে মৃত্যুর পর আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে।
আল্লাহ প্রাচুর্যময় বলেই তিনি যাকে ইচ্ছা দরিদ্র বিমোচন করে স্বচ্ছলতা দান করেন।
নেতার আনুগত্য করা সর্ববস্থায় জরুরী।
আর তিনি প্রজ্ঞাময় বলে তিনি জানেনকে সম্রাট হবার যোগ্য এবং তাঁকে নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব এবং রাজত্ব দান করেন।
এই কাহিনী থেকে বড় শিক্ষা হচ্ছে বংশ পরিচয় কোনো যোগ্যতা নয়।
একজন সম্রাটকে জনতার সমস্যা সমাধানের নির্দেশনা এবং তাদের পরিচালনা করতে হয় এজন্য জ্ঞান ও শাররীক ক্ষমতা দুটোই প্রয়োজন যা তালুতের ছিল।
আল্লাহর বাণী ও নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করা হচ্ছে আল্লার প্রতি শ্রদ্ধা জানান এবং সে সাথে জীবনে সফলতার চাবি। বনী ঈসরাঈলীরা আল্লাহর বাণী সিন্দুকে বন্ধ করে রেখে নিজের ইচ্ছামত জীবন যাপন করে এবং অপরদিকে আল্লাহর করুণার প্রত্যাশ্যা করে। যার প্রতিফলন আমরাও আমাদের জীবনে দেখতে পাই। অনেকেই না বুঝে কুরআন তেলওয়াত করে এবং শ্রদ্ধার সাথে ধর্ম পুস্তককে বাক্স বন্দী করে রাখে । যেহেতু না পড়ে কুরআন পড়ে সেহেতু বাস্তব জীবনে কুরআনের প্রতিফলন নাই।