সূরা বাকারা। রুকু ২৬। বিচার এবং ক্লেশ।
কুরআন পড়ুন, বুঝে পড়ুন
নিজে জানুন অন্যকে বলুন।
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু।
সূরা বাকারা । রুকু ২৬
আয়াত ২১১-২১৬।
বিচার এবং ক্লেশ
আয়াত অনুযায়ী আলোচ্য বিষয়:
২১১ নং আয়াত: সত্যদ্রোহীতার শাস্তি।
—-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(২১১) বনী ঈসরাঈলীকে জিজ্ঞাসা কর, আমি তাহাদেরকে কত স্পষ্ট নিদর্শন প্রদান করিয়াছি! আল্লাহর অনুগ্রহ আসিবার পর কেহ উহা পরিবর্তন করিলে আল্লাহ তো শাস্তিদানে কঠোর।
—-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
মহান আল্লাহ বনী-ঈসরাঈলীদের অনেক স্পষ্ট নিদর্শন দিয়েছিলেন।
যেমন: মূসা (আঃ) এর লাঠি। যার দ্বারা তিনি যাদুকরদের পরাস্ত ও সমুদ্রে পথ তৈরী করেন। পাথর হতে বারটি ঝরনা প্রবাহিত করেন। মেঘের ছায়া এবং মান্না ও সালওয়া অবতরণ করেন।
আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহ থাকার পরও তারা অসন্তুষ্ট ছিল এবং তার পরিবর্তন কামনা করে।
তারা আল্লাহর নির্দেশিত পথ ত্যাগ করে ও নেয়ামতকে বিকৃত করে।
তারা ঈমানের পরিবর্তে কুফরী ও বিমুখতার পথ অবলম্বন করে।
এর দ্বারা তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতারিত করছে।
আল্লাহর ন্যয়বিচার অবশ্যই এক সময় না এক সময় আসবে।
যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ভুলে যায় তাদের আল্লাহ কঠোর শাস্তি দান করবেন।
২১২ নং আয়াত: কাফের ও মুমিনের বিপরীতমুখী দৃষ্টিভংগী।
—-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(২১২) যাহারা কুফরী করে তাহাদের নিকট পার্থিব জীবন সুশোভিত করা হইয়াছে, তাহারা মুমিনদেরকে ঠাট্টা- বিদ্রূপ করিয়া থাকে। আর যাহারা তাকওয়া অবলম্বন করে কিয়ামতের দিন তাহারা তাহাদের উর্ধে থাকিবে। আল্লাহ যাহাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দান করেন।
—-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
কাফেরদের জন্য পার্থিব জীবন সুশোভিত করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ তারা সব ধরণের পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ এবং আরাম-আয়েশ ভোগ করে।
সত্য ও আধ্যাত্মিক জগতের প্রতি তাদের কোন রকম আগ্রহ নেই। ।
বিশ্বাসীরা তাদের তুলনায় দরিদ্র ছিল। তাই তাদেরকে নিয়ে উপহাস ও টিটকারী দিত।
বিদ্রূপকৃত অসহায় বিশ্বাসীরা উপহাস সত্বেও তাকওয়া অবলম্বন করে ।
আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে অপরিমিত জীবিকা দিয়ে থাকেন।
২১৩ নং আয়াত: রিসালতের স্বীকৃতি ও মতাদর্শের বিভিন্নতা।
—-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(২১৩) সমস্ত মানুষ ছিল একই উম্মত। অতঃপর আল্লাহ নবীগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেন। মানুষেরা যে বিষয়ে মতভেদ করিত তাহাদের মধ্যে সে বিষয়ে মীমাংসার জন্য তিনি তাহাদের সঙ্গে সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেন এবং যাহাদেরকে তাহা দেওয়া হইয়াছিল, স্পষ্ট নিদর্শন তাহাদের নিকট আসিবার পরে, তাহারা শুধু পরস্পর বিদ্বেষবশত সেই বিষয়ে বিরোধিতা করিত। যাহারা বিশ্বাস করে, তাহারা যে বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করিত, আল্লাহ তাহাদেরকে সে বিষয়ে নিজ অনুগ্রহে সত্যপথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ যাহকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন।
—-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এক সময় পৃথিবীর সব মানুষই এক সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল।
সবাই তাওহীদের উপর ছিল।
কালের বিবর্তনে তাদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়।
আল্লাহ নবী-রাসুল প্রেরণ করেন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে।
মানুষের মধ্যে মতভেদ দূর করার জন্য সত্যসহ কিতাব প্রেরণ করেন।
কিতাব প্রাপ্তদের মধ্যে আল্লাহর সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পরও তারা নিজেদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি করে।
এর প্রধান কারণ হচ্ছে তাদের স্বার্থ পরতা এবং অবাধ্যতা।
আল্লাহ বিশ্বাসীদের সত্য পথে পরিচালিত করেন।
আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে সরল পথে পরিচালিত করেন।
২১৪ নং আয়াত: জান্নাতের কণ্টকাকীর্ণ পথ।
—-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(২১৪) তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করিবে- যদিও এখনও তোমাদের নিকট তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনুরূপ অবস্থা আসে নাই? অর্থ-সংকট ও দুঃখ-ক্লেশ তাহাদেরকে স্পর্শ করিয়াছিল এবং তাহারা ভীত ও কম্পিত হইয়াছিল। এমন কি রাসুল এবং তাঁহার সঙ্গে ঈমান আনয়নকারিগণ বলিয়া উঠিয়াছিল ‘আল্লাহর সাহায্য কখন আসিবে?’ জানিয়া রাখ, অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য নিকটে।
—-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
জান্নাতে যেতে হলে প্রত্যেকটি মানুষকে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে।
এই পরীক্ষা আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকেও দিতে হয়েছিল।
আমাদের পূর্ববর্তীদের মত শাস্তি আল্লাহ এখনো দেন নি।
সাধারণত দুঃখ, কষ্ট, অর্থ-সংকট এবং দুর্ভাগ্য দিয়ে আল্লাহ পরীক্ষা করেন।
তারা এতই ভীত ও কম্পিত হয়েছিল রাসুল ও তাঁর ঈমানদার সঙ্গীরা কেঁদে বলেছিল, কখন আল্লাহর সাহায্য আসবে?
মহান আল্লাহ জানিয়ে দিচ্ছেন, আল্লাহর সাহায্য সর্বদা মানুষের অতি নিকটে।
২১৫ নং আয়াত: দান-সাদাকাতে অগ্রাধিকার পাওয়া খাতসমূহ।
—-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(২১৫) লোকে কি ব্যয় করিবে সে সম্বন্ধে তোমাকে প্রশ্ন করে। বল, ‘যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় করিবে তাহা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন এবং মুসাফিরদের জন্য। উত্তম কাজের যাহা কিছু তোমরা কর না কেন আল্লাহ তো সে সম্বন্ধে সম্যক অবহিত।
—-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
দান সম্পর্কে তিনটি প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে।
কি দান করবে?
-যা কিছু মানুষের জন্য মঙ্গলজনক তাই দান করবে
কাকে দান করবে?
প্রয়োজন বিবেচনা করে পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম, মিসকীন এবং মুসাফিরদের মধ্যে দান করতে হবে । এই দান অবশ্যই নিঃস্বার্থ এবং গ্রহীতার প্রয়োজন অনুযায়ী দান করতে হবে।
কিভাবে দান করবে ?
আমাদের দান করার সময় মনে রাখতে হবে আল্লাহ আমাদের সম্পর্কে ভালভাবে জানেন। আমাদের এই দান বাইরে ভাল মানুষ হবার জন্য নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
২১৬ নং আয়াত: ইসলামে জিহাদের গুরুত্ব।
—-------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(২১৬) তোমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান দেওয়া হইল যদিও তোমাদের নিকট ইহা অপ্রিয়। কিন্তু তোমরা যাহা অপছন্দ কর সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং যাহা ভালবাস সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ জানেন আর তোমরা জান না।
—-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ ফরয করা হয়েছে।
সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা হল আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা।
সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই হচ্ছে জিহাদ।
সাধারণত যুদ্ধ মানুষের নিকট অপ্রিয়।
মানুষ নিজের জন্য যা চায় তা অনেক সময় তার জন্য অকল্যাণকর হতে পারে।
আবার যেটা চায় না সেটা তার জন্য কল্যাণকর।
আসল কথা মানুষের জন্য কোনটি কল্যাণকর আর কোনটি অকল্যাণকর সে সম্পর্কে আল্লাহ ভাল জানেন।
অনুধাবন:
সর্বকালে সর্বযুগে দেখা যায় আল্লাহর মহিমা এবং স্পষ্ট নিদর্শন দেখার পর মানুষ নিজের মনমত কুফরী ও বিমুখতার পথ অবলম্বন করতে চায়। তারা নিজের মত অনুযায়ী আল্লাহকে বিশ্বাস করতে চায়। যেমন: নাস্তিকতা, ব্যক্তি পূজা, ত্রিতত্ত্বে বিশ্বাস ইত্যাদি। আমাদের এ ব্যপারে সতর্ক হতে হবে এবং আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলতে হবে।
আল্লাহর নিদর্শনকে অস্বীকার করলে আল্লাহর কাছ থেকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে।
মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ইচ্ছাসম্পন্ন ও যোগ্যতা দান করে। তিনি সবাইকে সমান রিযিক দান করেন না। আল্লাহ কাউকে বেশী রিযিক দেন। আপত দৃষ্টিতে আমাদের মনে হতে পারে - তারা এই অন্যায় করেছে তাদের পাওয়া উচিত নয়। মনে রাখতে হবে আল্লাহর পরিকল্পনা আমাদের বোঝা সম্ভব নয়। আল্লাহ অবশ্যই যাকে যে নেয়ামত দিয়েছেন তা সে আল্লাহর নির্দেশিত পথে সদ্ব্যবহার করেছে কিনা তার হিসাব আল্লাহ অবশ্যই নিবেন।
দুনিয়ার প্রতি আসক্তি মানুষকে সত্য হতে ফিরিয়ে রাখে এবং আল্লাহ বিমুখ করে তোলে। পার্থিব জীবনেরউন্নতি তাকে এত অহংকারী করে তোলে যে সে আল্লাহর দানকে অস্বীকার করে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না আল্লাহ যাকে যে অনুগ্রহ ও নেয়ামত দিয়েছেন তার প্রত্যেকটির পাই পাই হিসাব পরকালে আল্লাহর কাছে দিতে হবে।
মানুষকে দান করতে গেলে ফেলে দেয়া বা অপ্রয়োজনীয় জিনিস দান করা যাবে না। এমন জিনিস দান করতে হবে যা গ্রহীতার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। আর দান হতে হবে নিঃস্বার্থভাবে। বিনিময় আশা করা যাবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা গোপনে বা প্রকাশ্যে যাই করি না কেন আল্লাহ সব জানেন।
সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হচ্ছে জিহাদ।