সূরা বাকারা । রুকু ২৩। রামজান -স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে গভীর সম্পর্ক স্থাপন।
কুরআন পড়ুন, বুঝে পড়ুন
নিজে জানুন, অন্যকে বলুন।
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু।
সূরা বাকারা । রুকু ২৩
আয়াত ১৮৩ -১৮৮
রামজান -স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে গভীর সম্পর্ক স্থাপন।
যৌক্তিকতা:
এই মাসে একজন মুসলিম সিয়াম, কুরআন তিলওয়াত, নফল সালাত, দোয়া, এবং মহান আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে এবং সে সাথে নাফসের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষূধা-তৃষ্ণা সহ্য করে আত্ম সংযম সহকারে মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
আয়াত অনুযায়ী আলোচ্য বিষয়:
১৮৩ ও ১৮৪ নং আয়াত: সিয়াম। জৈবিক প্রয়োজন: খাদ্য, পানীয় ও যৌন অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ। (এ প্রবৃত্তি পশুর মধ্যে আছে।)
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(১৮৩) হে মুমিণগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হইল, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে দেওয়া হইয়াছিল, যাহাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(১৮৪) সিয়াম নির্দিষ্ট কয়েক দিনের জন্য। তোমাদের মধ্যে কেহ পীড়িত হইলে বা সফরে থাকিলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করিয়া লইতে হইবে। ইহা যাহাদেরকে সাতিশয় কষ্ট দেয় তাহাদের কর্তব্য ইহার পরিবর্তে ফিদয়া- একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করা। যদি কেহ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে তবে উহা তাহার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণপ্রসূ যদি তোমরা জানিতে।
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সিয়াম আল্লাহর দেয়া বিধান।
ঐতিহাসিক এবাদত যা পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ ছিল।
উদ্দেশ্য সিয়ামকারী যেন মুত্তাকী হতে পারে।
নির্দিষ্ট কয়টি দিন সিয়াম বাধ্যতামূলক।
অসুস্থ বা মুসাফির ব্যক্তির সিয়াম বাধ্যতামূলক নয়।
অন্য সময়ে এ সংখ্যা পূরণ করতে হবে।
সিয়ামের বদলে ফিদাইয়া বা অভাবগ্রস্থকে খাদ্য দান করবে।
স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎ কাজ করা অধিক কল্যাণকর।
সিয়াম পালন করা অধিকতর কল্যাণকর।
১৮৫ নং আয়াত : সিয়ামের মাস নির্ধারণ।
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(১৮৫) রামাযান মাস, ইহাতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হইয়াছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যাহারা এই মাস পাইবে তাহারা যেন এই মাসে সিয়াম পালন করে। এবং কেহ পীড়িত থাকিলে কিংবা সফরে থাকিলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করিবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যাহা সহজ তাহা চাহেন এবং যাহা তোমাদের জন্য কষ্টকর তাহা চাহেন না এইজন্য যে, তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করিবে এবং তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করিবার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করিবে এবং যাহাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতে পার।
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
রমজান মাস বা্ধ্যতামূলক সিয়াম পালন করার মাস।
এ মাসে পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে।
এই কুরআনের বৈশিষ্ট্য:
মানুষের হেদায়েতের উসিলা।
হেদায়েত বা সুপথ প্রাপ্তির সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ দেয়।
সত্য (হক) ও অসত্যের (বাতিল) মধ্যে পার্থক্য নির্দেশকারী।
১৮৩ নং আয়াতে সক্ষম ব্যক্তি সিয়াম পালন না করলে ফিদাইয়া দেবার ব্যবস্থা এ আয়াতে রহিত করা হয়।
অসুস্থ ও মুসাফির ব্যক্তি যাদের জন্য সিয়াম কষ্টদায়ক তাদের জন্য আপাতত সিয়াম মাফ।
কিন্তু রমজান মাস বাদে অন্য সময়ে সম পরিমাণ সিয়াম রাখতে হবে।
মহান আল্লাহ মানুষকে কষ্ট দিতে চান না।
তিনি এমনভাবে বিধান করেছেন যাতে মানুষ পালন করতে পারে।
আল্লাহ আমাদের সৎপথে পরিচালনা করছেন আমাদের আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে
বেশী করে তাকবীর বা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে হবে।
১৮৬ নং আয়াত: আল্লাহ বান্দার নিকটে থাকেন এবং দোয়া কবুল করেন।
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(১৮৬) আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্বন্ধে তোমাকে প্রশ্ন করে, আমি তো নিকটেই। প্রার্থনাকারী যখন আমার নিকট প্রার্থনা করে আমি তাহার প্রার্থনায় সাড়া দেই। সুতরাং তাহারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক, যাহাতে তাহারা ঠিক পথে চলিতে পারে।
—-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
বি.দ্র.: মানুষ যে কোন সময় যে কোন অবস্থাতেই থাকুক না কেন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে পারে। বরকতময় রমজান মাসের বিধি-বিধানের সাথে প্রার্থনার কথা উল্লেখ করে এ কথা পরিষ্কার করা হয়েছে যে রমজান মাস দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনার বিশেষ মাস। অতএব এ মাসে প্রার্থনা করার প্রতি খুব যত্ন নেয়া উচিত। বিশেষ করে রোজা থাকা অবস্থায়।
বিষয়বস্তু:
(ক) প্রার্থনা কবুলের জন্য কুরআন ও হাদীস যে শর্তাবলী আছে তা অনুসরণ করা আবশ্যক। এই আয়াতে দুটি শর্তের কথা বলা হয়েছে।
আল্লাহর উপর দৃঢ় ইমান রাখা।
তাঁর আনুগত্য এবং তাঁর দেয়া বিধিবিধান মেনে চলা।
(খ) এই ছোট্ট আয়াতে আল্লাহ বেশ কয়েকবার নিজের পবিত্র সত্বা ও বান্দার কথা উল্লেখ করেছেন এবং সে সাথে আল্লাহ নবী (সঃ) কে তাঁর বান্দাকে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের কথা বলতে বলেছেন। উদ্দেশ্য যাতে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।
আল্লাহ বান্দাদের অতি নিকটে আছেন।
আল্লাহ আশা করেন তাঁর বান্দা তাঁকে ডাকবে।
আল্লাহ বান্দাদের প্রার্থনা ও আহ্বান শোনেন।
প্রার্থনাকারীর আহ্বানে আল্লাহ তাঁর সান্নিধ্যের আশ্বাস দেন।
প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করেন।
বান্দাকে শুধু আল্লাহর কাছে চাইতে হবে এবং তাঁরই নির্দেশ পালন করবে।
আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে প্রার্থনাকারীকে।
আল্লাহ তাদের সঠিক পথে চালিত করবেন।
দোয়া হচ্ছে আল্লাহর সাথে কথপোকথন। এর মাধ্যমে আমরা আমাদরে একমাত্র ইলাহ মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে থাকি। বাস্তবে আমরা এখন দেখতে পাই আমরা পীর-মের্শেদ এদের কাছে গিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধারের প্রার্থনা করি। তারা যা বলে আমরা তা শুনি। অথচ আল্লাহর ডাক শুনিনা। এ আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে একমাত্র আল্লাহর কাছে আমরা প্রার্থনা করব। রমাজান সংক্রান্ত আলোচনার মধ্যে ১৮৬ নং আয়াতের উদ্দেশ্য হল এটা জানিয়ে দেয়া যে, শুধু রমাজান মাসে নয় আল্লাহ সব সময় আনুগত্যকারীর দোয়া কবুল করেন।
১৮৭ নং আয়াত: সীমানার মধ্যে খাদ্য ও যৌন ব্যবস্থাপনা।
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(১৮৭) সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী সম্ভোগ বৈধ করা হইয়াছে। তাহারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাহাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ জানেন যে, তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার করিতেছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হইয়াছেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করিয়াছেন। সুতরাং এখন তোমরা তাহাদের সঙ্গ সংহত হও এবং আল্লাহ যাহা তোমাদের জন্য নির্ধারণ করিয়াছেন তাহা কামনা কর। আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ রাত্রির কৃষ্ণ রেখা হইতে ঊষার শুভ্ররেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়। অতঃপর নিশাগম পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর। তোমরা মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় তাহাদের সংগে সংগত হইও না। এইগুলি আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং এইগুলির নিকটবর্তী হইও না। এইভাবে আল্লাহ তাহার বিথথানাবলী মানব জাতির জন্য সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, যাহাতে তাহারা মুত্তাকী হইতে পারে।
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
দিনের বেলা সিয়াম পালন।
যৌনতা ও অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকা।
সিয়ামের মাসে রাতের বেলা স্ত্রী সাহচর্য বৈধ।
আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও পাপ মোচন প্রার্থনা করলে আল্লাহ সদয় হন।
সুবহে সাদেক থেকে রাতের আগমন পর্যন্ত সিয়াম পালন।
রমাজান মাসে মসজিদে ইতিকাফ করা।
১৮৮ নং আয়াত: অসৎপথে উপার্জিত অর্থ হারাম।
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(১৮৮) তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করিও না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিয়দংশ জানিয়া-শুনিয়া অন্যায়ভাবে গ্রাস করিবার উদ্দেশ্যে উহা বিচারকগণের নিকট পেশ করিও না।
—--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
বস্তুগত বিশেষ করে অর্থ-সম্পদের লোভ থেকে সিয়ামকারীর নিজেকে রক্ষা করার উপর গুরুত্ব প্রদান।
অন্যের সম্পদ গ্রাস করা যাবে না।
মিথ্যা মামলায় কাউকে জড়ানো যাবে না।
অনুধাবন:
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আত্মসংযমের মাধ্যমে দেহ ও মনের পরিচ্ছন্নতা অর্জন হচ্ছে সিয়াম। সিয়াম অপ্রকাশ্য ইবাদত। এর ফলে রিয়া বা লোক দেখানো থেকে মুক্ত থাকা যায়।
রমাজান মাসে আত্মসংযম মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে শক্তিশালী করে।
এক মাস ধরে ক্ষুধার যন্ত্রণা উপলব্ধি করায় অসহায়, দরিদ্র মানুষের ক্ষুধার যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারে এবং তাদের সম্পর্কে সহানুভূতিশীল করে তুলে।
সিয়াম মানষের মধ্যে আল্লাহভীরুতার চেতনাকে আরো শক্তিশালী করে।
এই মাস রোজাদার মানুষের আত্মাকে পাপের কালিমা মুক্ত করে এবং অন্তরে কুরআনের প্রভাব তৈরীর জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করে।
আমাদের প্রার্থনা ও আহ্বান আল্লাহ শোনেন এবং সে সাথে তিনি আমাদের চাহিদা পূরণ করেন। তাই আমাদের শুধু তাঁর কাছেই চাইতে হবে এবং সে সাথে তার নির্দেশ পালন করতে হবে।
ইসলামী বিধানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, কোন বিধান পালন করা কঠিন হলে তখন আল্লাহতায়ালা সহজ করে দেন।
আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা হল নিজের উপর জুলুম করা।
ইসলাম বৈরাগ্যের ধর্ম নয়। তাই দিনে আত্মসংযমের ইবাদতের পর রাতে বৈধ আরাম আয়েশের অনুমতি দেয়।
ইসলাম অন্যের সম্পদ দখল না করর উপর জোর দিয়েছে। এমনকি এ সম্পর্কে চিন্তা করাকেও পাপ মনে করে।
ঘুষদেয়া এবং নেয়া সম্পূর্ণ হারাম।