সূরা আনফাল। রুকু - ৩

 কুরআন পড়ুন, বুঝে পড়ুন

নিজে জানুন, অন্যকে বলুন। 


দয়াময়, পরম দয়ালূ আল্লাহর নামে শুরু করছি।

সূরা আনফাল । রুকু -৩
আয়াত ২০ - ২৮। 
সাফল্যের পথ


আয়াত অনুযায়ী আলোাচ্য বিষয়: 


২০,২১ ও ২২ নং আয়াত : ঈমানী ব্যক্তিদের করণীয়। 

____________________________________________

(২০) ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য কর, আর যখন তোমরা শ্রবণ করো  সেটা থেকে তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিও না।

____________________________________________

(২১) আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা বলে, আমরা শুনলাম অথচ তারা শুনে না। 

____________________________________________

(২২) নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে বধির, বোবা নিকৃষ্টতম বিচরণশীল প্রাণী তারাই, যারা বেঝে না। 

____________________________________________

  • ঈমানদার ব্যক্তিদের আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করতে হবে। 

  • কুরআন ও তাঁর উপেদশ শ্রবণ করার পর অন্তর থেকে তা মেনে চলার আহ্বান। 

  • সে সব ব্যক্তিদের মত হতে নিষেধ করা হয়েছে যারা  মুখে বলে শুনলাম, কিন্তু শোনার পর তা থেকে কোন উপদেশ নিজের জীবনে প্রয়োগ করে না। 

  • তারা কান থাকা সত্বেও বধির এবং বাকশক্তি থাকা সত্বেও সত্য প্রকাশের সময় বোবা হয়ে যায়।

  • আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতর জীব সে সব মানুষেরা যারা এরকম সত্য শোনার পরও বধির ও মূক সেজে বসেছে এবং বিবেকের সাথে শত্রুতা করছে। 


২৩ নং আয়াত: অবাধ্যতা ।

____________________________________________

(২৩) আর যদি আল্লাহ জানতেন তাদের মাঝে কোন কল্যাণ আছে, তিনি অবশ্যই তাদেরকে শুনাতেন। আর যদি তিনি তাদেরকে  শুনাতেনও, তারা নিশ্চয়ই মুখ ফিরিয়ে নিত।  আর তারাই উপেক্ষাকারী।

 ____________________________________________

  • মহান আল্লাহ জানেন যে তাদের মধ্যে সত্যতা ও আগ্রহ নেই। 

  • মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের অন্তরকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখেন।

  • কিন্তু তিনি সেটা করেন না কারণ তারা  নিকৃষ্ট কাজ করতে করতে সত্যকে গ্রহণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। 

  • আল্লাহ ও রাসূলের আহ্বান তাদের কানে প্রবেশ করবে না। তারা উপেক্ষা করবে। 

  • বিশেষ করে আল্লাহর বাণী শুনলে যদি তাদের পার্থিব স্বার্থ ক্ষুন্ন হবার ভয় থাকে। 


২৪ নং আয়াত: আল্লাহ ও রাসুলের আহ্বানে সাড়া প্রদান। 

____________________________________________

(২৪) ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আল্লাহর জন্য ও রসুলের জন্য সাড়া দাও, যখন তিনি তোমাদেরকে সেটার জন্য ডাকেন, যা তোমাদেরকে প্রাণবন্ত করে। আর জেনে রাখ যে, আল্লাহ মানুষ ও তার অন্তরের মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকেন আর যে তিনি, তাঁর দিকেই তোমাদেরকে সমবেত করা হবে। 

____________________________________________

  • আল্লাহ রাসুল (সঃ) এর মাধ্যমে মানুষকে এমন এক জীবনের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন যে জীবন মানুষকে প্রাণবন্ত রাখবে।

  • এ জীবন মানুষকে পার্থিব স্বার্থপরতা ও সীমাবদ্ধতার উর্ধে ঊঠে সহজ, সরল আনন্দময় জীবন দিবে। 

  • মানুষের অন্তরে যা আছে তা মহান আল্লাহ সব জানেন।

  • মহান আল্লাহ মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে বিরাজ করেন।

  • কিয়ামত দিবসে সব মানুষ তাঁর সামনে সমবেত হবে।  


২৫ নং আয়াত : ফিতনা। 

____________________________________________

(২৫) আর তোমরা এমন ফিতনাকে ভয় করো, যা তোমাদের মধ্য থেকে যারা অবিচার করেছে শুধু তাদেরকেই আক্রান্ত করে না। আর জেনে রাখ যে, আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর। 

____________________________________________

বি.দ্র. : 'ফিতনা' শব্দের অর্থ পরীক্ষা, আঘাত  অথবা এমন অবস্থার সৃষ্টি যা গৃহযুদ্ধ ও আযাবের কারণে হয়ে থাকে। এছাড়া অত্যাচার, নিষ্পেষণ, অশান্তি, মতভেদ হতে পারে। 


  • মহান আল্লাহ ফিতনা অর্থ্যাত্‌ নিজেদের মধ্যে যে বিরোধ, দাঙ্গা -হাঙ্গামার সৃষ্টি হয় - তার থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। 

  • এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ যে ব্যক্তি ফিতনা সৃষ্টি করে তাতে সীমাবদ্ধ থাকে না, সমাজের অন্যান্য লোকেরাও এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। 

  • মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর। 


২৬ নং আয়াত: হিজরতের আগে ও পরে  মুসলিমদের অবস্থা ।

____________________________________________
(২৬) আর স্মরণ করো, যখন তোমরা অল্পসংখ্যক, পৃথিবীর মধ্যে অসহায়, তোমরা ভয় করতে যে, লোকেরা হঠাত্‌ তোমাদের ধরে নিয়ে যাবে, তখন তিনি তোমাদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং তাঁর সাহায্য দিয়ে তোমাদেরকে শক্তিশালী করেছেন। আর উপযোগী বস্তুর মধ্য থেকে তোমাদেরকে রিযিক দিয়েছেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। 

____________________________________________

  • মুসলিমরা অবিশ্বাসীদের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত হত। 

  • তাদেরকে গুম করে দিত। 

  • মহান আল্লাহ তাদের বিভিন্ন স্থানে হিজরত করার নির্দেশ দেন। 

  • তারা নিঃস্ব ছিল। 

  • মহান আল্লাহ কিছুদিনের মধ্যে তাদের এই নিঃস্ব অবস্থা থেকে উদ্ধার করেন । 

  • তাদের হালাল রিযিক দেন। 

  • আল্লাহ তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বলেছেন।  


২৭ নং আয়াত:  বিশ্বাসঘাতকতা না করা এবং আমানতের খেয়ানত না করার নির্দেশ। 

____________________________________________

(২৭) ওহে, যারা ঈমান এনেছ! তোমরা না আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিশ্বাসঘাতকতা করবে কিংবা তোমাদের আমানতের বিশ্বাসঘাতকতা করবে,  অথচ তোমরা জানো।

____________________________________________

  • অত্যন্ত গর্হিত দুটো কাজ। প্রথমত হল বৈষয়িক স্বার্থে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। দ্বিতীয়ত: আমানতের খেয়ানত করা।  


বি.দ্র.: আমানত বৈষয়িক ও অবৈষয়িক হতে পারে। তিন ভাগে ভাগ করা যায়। (১) বিষয় সম্পত্তি, জিনিসপত্র, গচ্ছিত মাল প্রভৃতি।

(২) গোপন পরিকল্পনা, কথা বা বিশ্বাস। (৩) জ্ঞান, প্রতিভা, সুযোগ-সুবিধা যা আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত। 

তিনভাবে খেয়ানত করতে পারে। (১) অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে। (২) বিশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। (৩) ক্ষমতা বা জ্ঞানের অপব্যবহার করে। 


২৮ নং আয়াত: আল্লাহর পরীক্ষা।

____________________________________________

(২৮) আর জেনে রাখ, প্রকৃতপক্ষে তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি একটি পরীক্ষা। আর এটাও যে, আল্লাহই, তাঁর কাছেই বিরাট প্রতিদান। 

____________________________________________

  • দুটো বিষয়ে পরীক্ষা নেন: ১মত পার্থিব অর্থ-সম্পদের প্রতি মোহ এবং ২য়ত সন্তানের প্রতি ভালবাসা। 

  • যে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবে তার জন্য আল্লাহর কাছে আছে উত্তম পুরস্কার। 


আমার অনুধাবন: 

  • কুরআনের উপদেশ অন্তর দিয়ে গ্রহণ করা। মুখে বললাম:  শুনলাম ও আমি সব মেনে চলব - বাস্তবে তা করলাম না। অর্থ্যাৎ কথায় ও কাজে কোন পার্থক্য করা যাবে না। 

  • যে শুনে উপকার বা উপদেশ গ্রহণ করেনি তা শ্রবণ করা নয়। তাদের অবস্থা মুনাফিক ও মুশরিকদের মত। 

  • মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে মানুষের বিবেক, বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি আছে যা পশুদের নাই। যে মানুষ  তাদের কাজে কর্মে চিন্তা শক্তি বা বুদ্ধি বৃত্তিকে কাজে লাগায় না, অন্যকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে সে পশুরও অধম। সমাজে দেখা যায় একশ্রেণীর মানুষ যারা সত্যকে শ্রবণ করার পরও তা অনুধাবন করে না। তাদের কান, জিহ্বা ও বিবেককে কাজে লাগায় না। তারা পশু থেকে নিকৃষ্টতর। তারা দেখে শুনে মূক ও বধির । 

  • আল্লাহ প্রত্যেক ব্যক্তির ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী দায়িত্ব প্রদান করেন। যারা নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে ফেলেছে,  আল্লাহ ও রাসুলের আহ্বানে সাড়া দিলে পার্থিব ক্ষতি হতে পারে তারা  আল্লাহর আহ্বান শুনবে না। সমাজের কল্যাণের জন্য তারা কখনো কোন স্বার্থত্যাগ করবে না। মহান আল্লাহ মানুষকে সত্য গ্রহণে বাধ্য করার ক্ষমতা থাকা সত্বেও তাকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন।    

  • মানুষকে শোনা ও বলার ক্ষমতা এবং সে সাথে বিবেক-বুদ্ধি ও ইচ্ছা শক্তি  দিয়েছেন। মানুষের ইচ্ছা সে প্রবৃত্তির অনুসরণ করবে না আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দেখানো জীবনের পথ অবলম্বন করবে।  মহান আল্লাহ মানুষের অত্যন্ত নিকটে অর্থ্যাত্‌ অন্তরের  অন্তস্থলে আছেন। মানুষের সব কিছুই তিনি জানেন।কোন কিছু তাঁর অগোচরে ঘটেনা। কিয়ামতের দিন যখন সবাই একত্রিত হবে সেদিন সব প্রকাশিত হবে। 

  • একটি সমাজে যখন অন্যায়-অত্যাচার হয় তার প্রতিবাদ না করে নীরব হয়ে থাকলে সমাজের প্রতিটি লোক তার শাস্তি ভোগ করবে। আমি করিনি বলে চুপ করে বসে থাকলে শাস্তির হাত থেকে বাঁচা যাবে না। প্রত্যেক বিশ্বাসী ব্যক্তির উচিত নিজে অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা এবং সে সাথে অন্য ব্যক্তিকেও সু পরামর্শ ও সংশোধনের চেষ্টা করা । 

  • এই রুকুতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুধাবন হচ্ছে ইসলামের প্রথম যুগে মুসলিমদের যে কঠিন অবস্থা ছিল তা থেকে উত্তরণ। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী  জীবন পরিচালনা করে যে অফুরন্ত নেয়ামতের অধিকারী হয়েছিল। এর জন্য আমাদের আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা কর্তব্য। 

  • আল্লাহ আমাদের দেহ-প্রাণ, পার্থিব অর্থ- সম্পদ, সন্তান প্রভৃতির সাথে সাথে ধর্ম ও জীবন দর্শন দিয়েছেন। এসব কিছুই হচ্ছে  আমাদেরকে দেয়া আল্লাহর আমানত। এর খেয়ানত করা যাবে না।  

  • মানুষ সাধারণত অন্যায় আচরণ করে সম্পদের লোভে এবং নিজ সন্তানদের প্রতি অন্ধ ভালাবাসায় পড়ে। কারণ সম্পদের প্রতি মোহ ও সন্তানের প্রতি ভালবাসা মানুষের মজ্জাগত বিষয়।  কাজেই মহান আল্লাহ এ দুটোকে বড় পরীক্ষা হিসাবে অভিহিত করেছেন । যৌক্তিক সীমার মধ্যে থাকলে এটা দোষণীয়নয়। এই ভালবাসা যদি আল্লাহর দেয়া সীমারেখার মধ্যে হয় তবে সওয়াব পাওয়া যাবে। কিন্তু এগুলোর প্রতি আকর্ষণ পাপের দিকে নিয়ে যায় তা বিরাট মুসিবতের কারণ। 

  •  এটা একটি সাধারণ নিয়ম যে, যে কোন মহত্‌ কাজ শুরুতে খুব ছোট থাকে। তখন দেখা যায় সমসাময়িক লোকেরা তা প্রত্যখ্যান করে এবং  অত্যাচারিত হয়। কিন্তু আল্লাহর উপর অবিচল আস্থা রেখে সঠিক পথ অবলম্বন করা যায় তবে আল্লাহর সাহায্য তার কাছে পৌছে যায়।  আল্লাহর রহমতে সে জয়যুক্ত হয়। 



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url