সূরা আনফাল - রুকু ১।
কুরআন পড়ুন, বুঝে পড়ুন
নিজে জানুন, অন্যকে বলুন।
সূরা আনফাল, রুকু - ১।
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
আয়াত ১-১০।
যুদ্ধলব্ধ সম্পদ।
সূরা আনফালের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
মদীনায় অবতীর্ণ। আয়াত ৭৫ । রুকু ১০।
নামকরণ: 'আনফাল' শব্দটি 'নফল শব্দের বহুবচন। নয়ল অর্থ হল অতিরিক্ত।
এই সূরার মূল বিষয় বস্তু বদরের যুদ্ধ ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলীর সাথে সম্পৃক্ত। ইসলাম ও কুফরের মধ্যকার নিয়মতান্ত্রিক যুদ্ধের মধ্যে এটাই সর্ব প্রথম।
প্রেক্ষাপট: মদীনায় হিজরতের দ্বিতীয় বছরে বদর প্রান্তরে মক্কার অধিবাসী কাফের সম্প্রদায় এবং মুসলমানদের মধ্যে এক অসম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে কাফের বাহিনীর সংখ্যা ছিল মুসলমানদের দুই গুণের বেশী। এই যুদ্ধে কাফেররা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। যুদ্ধে প্রচুর গণিমতের মাল মুসলমানদের হাতে আসে। এই বিপুল গণিমতের মাল বণ্টন নিয়ে সাহাবায়ে কিরাম তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই তিনভাগের এক ভাগ রসুল (সঃ) এর হিফাজতে নিযুক্ত ছিলেন,একদল শত্রুর পশ্চাদ্ধাবন করে এবং আরেকদল শত্রুর ফেলে যাওয়া সম্পদ কুড়াতে শুরু করে। এই তৃতীয় দল মনে করে এই গণিমতের সম্পদ একমাত্র তাদেরই। যুদ্ধ শেষ হবার পর বাকী দুই দলও গণীমতের সম্পদ দাবী করে। এটা নিয়ে তাদের মধ্যে বাদানুবাদ হয়। তখন এই আয়াত নাযিল হয়।
১ নং আয়ত: যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সম্পর্কে মৌলিক নীতিমালা।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(১) লোকে তোমাকে যুদ্ধে লব্ধ সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে; বল, ‘যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আল্লাহ এবং রাসুলের; সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর এবং নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন কর, এবং আল্লাহ ও তাঁহার রাসুলের আনুগত্য কর, যদি তোমরা মুমিন হও।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------’
যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হচ্ছে আল্লহ ও রাসুলের।
রাসুল (সঃ) নিজে বণ্টন করবেন।
আল্লাহকে ভয় করতে হবে।
নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব রাখতে হবে।
বিশ্বাসী হলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করতে হবে।
২, ৩, ও ৪ নং আয়াত: মুমিনের গুণাবলী।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(২) মুমিন তো তাহারাই, যাহাদের হৃদয় কম্পিত হয় যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং যখন তাঁহার আয়াত তাহাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন উহা তাহাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং তাহারা তাহাদের প্রতিপালকের উপরই নির্ভর করে,
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(৩) যাহারা সালাত কায়েম করে এবং আমি যাহা দিয়াছি তাহা হইতে ব্যয় করে;
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(৪)তাহারাই প্রকৃত মুমিন। তাহাদের প্রতিপালকের নিকট তাহাদেরই জন্য রহিয়াছে মর্যাদা, ক্ষমা এবং সম্মানজনক জীবিকা।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আল্লাহকে স্মরণ করে।
আল্লাহকে স্মরণের সময় ভয়ে হৃদয়ে বিশেষ স্পন্দন শুরু হয়।
কুরআনের আয়াত পড়ে তাদের বিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং ঈমানের উন্নতি হয়।
আল্লাহর উপর নির্ভর করে।
আল্লাহর স্মরণে তারা বিনয়ে মস্তক অবনত করে।
তারা যথাযথভাবে সালাত কায়েম করে।
আল্লাহ তাকে যে রিযিক দিয়েছেন তা থেকে যাকাত ও দান-খয়রাত করেন।
তারা অল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদা পূর্ণ স্থান লাভ করবেন।
বিশেষ ক্ষমা পাবেন।
মহান আল্লাহ তাদের দিবেন মর্যাদা, ক্ষমা করবেন এবং সম্মানজনক জীবিকার ব্যবস্থা করবেন।
৫ ও ৬ নং আয়াত: যুদ্ধ যাত্রাকালে সাহাবাদের মতভেদ।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(৫) ইহা এইরূপ, যেমন তোমার প্রতিপালক তোমাকে ন্যায়ভাবে তোমার গৃহ হইতে বাহির করিয়াছিলেন অথচ মুমিনদের এক দল ইহা পছন্দ করে নাই।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(৬) সত্য স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হওয়ার পরও তাহারা তোমার সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়। মনে হইতেছিল তাহারা যেন মৃত্যুর দিকে চালিত হইতেছে আর তাহারা যেন উহা প্রত্যক্ষ করিতেছে।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
তাদের যুক্তি ছিল মুসলমানরা এত বড় বিশাল বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার উপযুক্ত নয়।
সত্য (এখানে জেহাদের ঘোষণা) স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হবার পরেও তারা বিতর্কে লিপ্ত হয় ।
তাদের হাব ভাব দেখে মনে হচ্ছিল তাদেরকে যেন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
এবং এই ঘটনা যেন তারা প্রত্যক্ষ করছে।
আল্লাহর রাসুল (সঃ) বেশীর ভাগ সাহাবীর মতানুসারে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
মহান আল্লাহ সত্য পন্থী মুসলিম বাহিনীকে বিজয় দান করবেন তা প্রকাশ হবার পরও বিতর্কে লিপ্ত হয়।
অর্থ্যাৎ তারা পূর্ণরূপে আল্লাহর উপরে নির্ভর করতে পারছিল না।
বদর যুদ্ধের পটভূমি:
আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কুরায়েশদের এক বাণিজ্যিক দল প্রচুর সম্পদ নিয়ে মক্কায় ফিরছিল। সিরিয়া থেকে মক্কায় যাওয়ার পথে মদীনা পড়ে। আবু সুফিয়ানের মনে ভয় ছিল মদীনার নও মুসলিমরা তাদের আক্রমণ করতে পারে। এই ভয়ের বশবর্তী হয়ে আবু সুফিয়ান মক্কার কুরায়েশদের সাহায়্য প্রার্থনা করে। মুসলিমদের সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। হয় নিরস্ত্র বাণিজ্য বহরকে আক্রমণ করা। অথবা সাহায়্যকারী সশস্ত্র কুরায়েশ বাহিনীর গতি রোধ করা।
৭ ও ৮ নং আয়াত: আল্লাহর প্রতিশ্রুতি।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(৭) স্মরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, দুই দলের একদল তোমাদের আয়াত্তাধীন হইবে; অথচ তোমরা চাহিতেছিলে, নিরস্ত্র দলটি তোমাদের আয়াত্তাধীন হউক। আর আল্লাহ চাহিতেছিলেন যে, তিনি সত্যকে তাঁহার বাণী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেন এবং কাফিরদেরকে নির্মূল করেন;
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(৮) ইহা এইজন্য যে, তিনি সত্যকে সত্য ও অসত্যকে অসত্য প্রতিপন্ন করেন, যদিও অপরাধীরা ইহা পছন্দ করে না।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
মহান আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে দুই দলের একদলকে মুসলিমদের অধীন করে দেবেন।
মুসলমানরা চাচ্ছিল নিরস্ত্র দলটিকে আয়ত্তাধীনে আনতে।
আল্লাহ চান সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং কাফিরদের নির্মুল করতে।
রসুল (সঃ) কুরাইশদের মুখোমুখি হবার সিদ্ধান্ত নেন।
জিহাদ শুরু হয়।
আল্লাহ সত্যকে সত্য ও অসত্যকে অসত্য প্রতিপন্ন করেন।
অবিশ্বসীদেরদের তা পছন্দ ছিল না।
৯ ও ১০ নং আয়াত: মুসলমানদের ঐশী সাহায়্য।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(৯) স্মরণ কর, যখন তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছিলে; তখন তিনি তোমাদেরকে জবাব দিয়াছিলেন, ’আমি তোমাদেরকে সাহায্য করিব এক সহস্র ফিরিশতা দ্বারা, যাহারা একের পর এক আসিবে।’
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(১০) আল্লাহ ইহা করেন কেবল শুভ সংবদ দেয়ার জন্য এবং এই উদ্দেশ্যে, যাহাতে তোমাদের চিত্ত প্রশান্তি লাভ করে ;এবং সাহায্য তো শুধু আল্লাহর নিকট হইতেই আসে; নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
মুসলিম বাহিনীকে ফেরেশতা পাঠিয়ে আল্লাহ সাহায্য করেন।
আল্লাহ মানুষকে সাহায্য করেন তার খুশী ও অন্তরের প্রশান্তির জন্য।
আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।
আমার অনুধাবন:
যুদ্ধেলব্ধ সম্পদ বৈষম্যপূর্ণ নীতিতে নয় সাম্যের ভিত্তিতে বণ্টন করতে হবে যা রাসুল (সঃ) করেছিলেন। বর্তমান যুগে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ নেই। কিন্তু বিপুল পরিমাণ বনাঞ্চল, পরিত্যক্ত জমি. সরবারী বা লখেরাজ সম্পত্তি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ আছে যা সাম্যের ভিত্তিতে বণ্টিত করা যায়।
আল্লাহকে আমরা ভয় করি কিনা বা আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করি কিনা তা বাস্তব জীবনে আমাদের বাস্তব কর্মক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়।
যেমন পার্থিব সম্পদের মোহ বা কোন বৈষয়িক স্বার্থের জন্য হিংসা ও বিদ্বেষে লিপ্ত হওয়া । যার আল্লাহ ভীতি আছে সে এ কাজ থেকে দূরে থাকবে।
যুদ্ধের সময় নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক ভাল রাখা এবং সদ্ভাব বজায় রাখা জরুরী। নিজেরা বিভেদে লিপ্ত থাকা অর্থ শত্রু পক্ষকে সহায়তা করা।
সত্যিকারের মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে তাদের ইচ্ছা থাকলেও পাপ কর্মে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকে। তারা সব অবস্থায় সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল থাকে আল্লাহর উপর। সোজা কথায় আল্লাহ ভীতি মানুষকে অপরাধ করা হতে দূরে রাখে।
তারা আল্লাহর নির্দেশ পালন করে। যেমন - আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক থেকে তারা দান-খয়রাত করে। কোন হারাম উপার্জনের দিকে তারা যায় না। এর ফলে স্রষ্টার সাথে গড়ে উঠে এব বিশেষ সম্পর্কের বন্ধন।
ঈমান হচ্ছে মানুষের মনের বিশ্বাস ও অনুভূতি যা মানুষের আচরণ ও বাহ্যিক কাজকর্মে প্রতিফলিত হয়।
আল্লাহর স্মরণ ও কুরআন তেলওয়াতে ঈমান আরো শক্তিশালী হয়।
রসুল (সঃ) অধিকাংশ সাহাবীদের মতানুযায়ী যুদ্ধে যাবার সিদ্ধান্ত নেন এবং ঐশী সাহায্য লাভ করেন। সংখ্যাগুরুর মতকে প্রধান্য দিতে হবে।
মুসলিমরা সহজে সম্পদ লাভের ইচ্ছা পরিত্যাগ করে কঠিন কাজ - যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বিজয় লাভ করে । তারা আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্ত হয়। এখান থেকে বোঝা যায় পরিশ্রম লব্ধ কাজের ফল হচ্ছে গৌরবময়।
যে কোন কাজে পরিশ্রম এবং আল্লাহর উপর নির্ভরতা দুটোই প্রয়োজন।
মুসলিমরা সহজে প্রাপ্ত পার্থিব সম্পদের লোভ ত্যাগ করে সত্যকে আল্লাহর বাণী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যুদ্ধে মহান আল্লাহ কর্তৃক সাহায্যপ্রাপ্ত হয় এবং বিজয় লাভ করে।
মানুষের বিপদ ও দুঃখের দিনে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর সাহায্য চাইলে আল্লাহ সাহায্য করেন। আমাদের প্রয়োজন, পরিবেশ এবং মানসিকতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আল্লাহ সাহায্য করেন। যেমন বদরের যুদ্ধে মহান আল্লাহ করেছেন।
মানুষের স্বভাব হল কোনও জিনিসের আসবাব-উপকরণ সামনে পেলে তাতে তার আস্থা বেশী হয়। যে উপকরণসমূহ দিয়ে সমস্যার সমাধান হয়, মনে রাখতে হবে তা আল্লাহর সৃষ্টি। উপকরণসমূহের কার্যকারিতা আল্লাহর হুকুমে বাস্তবায়িত হয়।
’ফেরেশতারা সাহায্য করছে’ - এ বাণী মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে । এই আত্মবিশ্বাস তাদের অনুপ্রাণিত করে এবং তারা জয়লাভ করে। যে কোন বিপদ মোকাবিলা করার জন্য আত্মবিশ্বাস থাকা অতীব প্রয়োজন।