সূরা বাকারা, রুকু -৮।

 কুরআন পড়ুন, বুঝে পড়ুন
    নিজে জানুন, অন্যকে বলুন।


সূরা বাকারা রুকু - ৮

দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।

আয়াত :৬২ -  ৭১

ঈসরাঈলীদের অধঃপতন


৬২ নং আয়াত: ক্ষমা পাবার কানুন। 
__________________________________________________________
(৬২) নিশ্চয়ই যাহারা ঈমান আনিয়াছে, যাহারা ইয়াহুদী হইয়াছে এবং খ্রীষ্টান ও সাবিঈন- যাহারাই আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান আনে ও সত্‌কাজ করে, তাহাদের জন্য পুরস্কার আছে তাহাদের প্রতিপালকের নিকট। তাহাদের কোন ভয় নাই এবং তাহারা দুঃখিতও হইবে না। 
____________________________________________________________________________
ইহুদীদের বিশ্বাস ছিল যে, কেবল তাদের বংশই আল্লাহ তা'য়ালার প্রিয় ও মনোনীত বান্দা। তাদের বংশের বাইরে আর কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের উপযুক্ত নয়। 
  • সত্য কোনও বংশের এক চেটিয়া ব্যাপার নয়। 
  • মূল বিষয় ঈমান ও সত্‌ কর্ম।
  • যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের উপর ঈমান আনে  ও সত্‌ কর্মের  মূল নীতি মেনে চলে তাকেই আল্লাহ পুরস্কৃত করেন। 
  • তাদের কোন ভয় নেই এবং তাদের দুঃখিত হতে হবে না। 

৬৩ ও ৬৪  নং আয়াত: মূসা (আঃ) এর আনুগত্য ও তওরাতের অনুসরণের অঙ্গীকার। 
____________________________________________________________________________
(৬৩) স্মরণ কর, যখন তোমাদের অঙ্গীকার নিযাছিলাম এবং  'তুর'কে তোমাদের উর্ধে উত্তোলন করিয়াছিলাম; বলিয়াছিলাম, 'আমি যাহা দিলাম দৃঢ়তার সঙ্গে গ্রহণ কর এবং তাহাতে যাহা আছে তাহা স্মরণ রাখ, যাহাতে তোমরা সাবধান হইয়া চলিতে পার।' 
____________________________________________________________________________
(৬৪)  ইহার পর তোমরা মুখ ফিরাইলে । আল্লাহর অনুগ্রহ ও অনুকম্পা তোমাদের প্রতি না থাকিলে তােমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্থ হইতে। 
____________________________________________________________________________
  • হজরত মূসা (আঃ)কে  তাওরাত  কিতাব দেয়া হয় তখন বনী ঈসরাঈলীদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নেয়া হয় তাওরাতকে মান্য করবে এবং এর বিধানাবলী বাস্তবায়ন করবে।  
  • উদ্দেশ্য ছিল যাতে তারা আল্লাহ ভীরু হতে পারে।
  • কিন্তু অঙ্গীকারের পরও তারা ঐশী নির্দেশ অমান্য করে ।
  • কিন্তু দয়াময় আল্লাহ তাদের শাস্তি দানে বিরত থাকেন।   
বনী ঈসরাঈলীদের কাহিনী ১৪::
তুর পর্বত আরবের মরুভূমিতে অবস্থিত একটি অন্যতম পর্বত। এই জায়গায় বাইবেলে বর্ণিত দশটি বিধান হযরত মূসা (আঃ)কে দেয়া হয়। 
এখানকার কাহিনীটি হল মহান আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ)কে তাওরাত দেবার পর তা মান্য এবং বিধানাবলী বাস্তবায়নের আদেশ দেন। বনী ঈসরাঈলীরা লক্ষ্য করে দেখল কোন কোন বিধান খুব কঠিন। তাই তারা এই বিধানাবলী থেকে বাঁচার জন্য টালবাহানা করা শুরু করল। প্রথমে তারা বলল স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাকে  আমাদের বলতে হবে , তাওরাত মান্য কর। আমরা নিজের কানে শুনতে চাই। যদিও তাদের দাবী অযৌক্তিক ছিল, তবুও প্রমাণ করার জন্য তাদের দাবী মেনে নেয়া হয়। তাদের মধ্য থেকে ৭০ জন বাছাইকৃত লোক নিয়ে মূসা (আঃ) তুর পাহাড়ে গমন করেন। মহান আল্লাহ সরাসরি তাদেরকে তাওরাতের বিধানাবলী মেনে চলার হুকুম দেন। 
বনী ঈসরাঈলীদের কাহিনী ১৫। 
তারা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে এসে আল্লাহর হুকুমের কথা শুরু করে। কিন্তু তার সাথে নিজেদের একটি কথা যোগ করে দেয়। তারা বলে, আল্লাহ বলেছেন  যে, তোমারা যতটুকু পার মেনে চলবে; যা পারবে না তা আমি ক্ষমা করে দেব। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ তুর পাহাড়কে তাদের মাথার উপর তুলে তাওরাতের সকল বিধান মেনে চলতে নির্দেশ দেন। তখন তারা পর্বতটি তাদের মাথার উপর ছেড়ে দিতে পারে .এই   ভয়ে আল্লাহকে তওরাতের বিধানাবলী মেনে চলার অঙ্গীকার দেয়। 
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে , কাউকে চাপ সৃষ্টি করে ঈমান আনতে বাধ্য করা যায় না বটে, কিন্তু কেউ যদি ঈমান আনার পর নাফরমানী শুরু করে তবে তাকে শাস্তি দেয়া যায়। বনী ঈসরাঈলীরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিল বিধায় তাদের ভয় দেখানো হয়েছিল।

৬৫  ও ৬৬ নং আয়াত: সীমালংঘন করার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। 
____________________________________________________________________________
(৬৫)  তোমাদের মধ্যে যাহারা শনিবার সম্পর্কে  সীমা লংঘন করিয়াছিল তাহাদেরকে তোমরা নিশ্চিতভাবে জান।আমি তাহাদের  বলিয়াছিলাম , 'তোমরা ঘৃণিত বানর হও।' 
____________________________________________________________________________
(৬৬)  আমি ইহা  তাহাদের  সমসাময়িক  ও পরবর্তিীগণের শিক্ষা গ্রহণের জন্য  দৃষ্টান্ত  ও মুত্তাকীদের জন্য উপদেশস্বরূপ করিয়াছি। 
____________________________________________________________________________
  • শনিবার ইহুদীদের আয়-রোজগারমূলক তত্‌পরতা নিষিদ্ধ ছিল। 
  • মহান আল্লাহ এই দিনকে বিশ্রামের দিন হিসাবে ঘোষণা করেন।
  • তারা এই নিষেধাজ্ঞা  অবজ্ঞা করে   প্রকাশ্যেই মাছ ধরা শুরু করে। 
  • আল্লাহ শাস্তি হিসাবে তাদের বানর অর্থ্যাত্‌ পশুতে রূপান্তরিত  করে দেন। 
  • আল্লাহ সমসাময়িক এবং ভবিষ্যতের  মানুষদের  দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা দেবার জন্য  তা করেছেন।  
  • যারা সাবধানী ও মুত্তাকী  তারা এখান থেকে উপদেশ গ্রহণ করবেন। 
বনী ঈসরাঈলীদের কাহিনী ১৬।
হযরত দাউদ (আঃ) এর সময় ইহুদীদের জন্য শনিবার দিনটি সম্মানিত ও পবিত্র এবং ইবাদতের জন্য নির্ধারিত ছিল। এই দিন তাদের জন্য কোন রকম আয়-রোজগারমূলক কাজ করা নিষিদ্ধ ছিল। এখানে যে ইহুদী সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়েছে তারা সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করত এবং মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। তারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে বেশী লাভের আশায় মাছ ধরা শুরু করে। এর ফলে তারা আল্লাহর রোষানলে পতিত হয় এবং আল্লাহ তাদের আকৃতিতে বানর বানিয়ে দেন। 

৬৭ নং আয়াত: গাভী জবাইর ঘটনা। 
____________________________________________________________________________
(৬৭) স্মরণ কর, যখন মূসা আপন সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল, 'নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে একটি গরু  যবেহ করার আদেশ দিয়াছেন, তাহারা বলিয়াছিল, 'তুমি কি আমাদের সাথে ঠাট্টা করিতেছ? মূসা বলিল 'আল্লাহর শরণ লইতেছি.   যাহাতে আমি অজ্ঞদের অন্তর্ভূক্ত না হই। 
____________________________________________________________________________
(৬৮) তাহারা বলিল, 'আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানাইয়া দিতে বল, উহা কিরূপ? মূসা বলিল, 'আল্লাহ বলিতেছেন, উহা এমন এক গরু যাহা বৃদ্ধও নয়, অল্পবয়স্কও নয়-মধ্যবয়সী। সুতরাং তোমরা যা আদিষ্ট হইয়াছ তাহা কর। 
____________________________________________________________________________
(৬৯) তাহারা বলিল, 'আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানাইয়া দিতে বল, উহার রং কি? মূসা বলিল, 'আল্লাহ বলিতেছেন, উহা হলুদ বর্ণের গরু, উহার রং উজ্জ্বল গাঢ়, যাহা দর্শককে আনন্দ দেয়।' 
____________________________________________________________________________
(৭০) তাহারা বলিল, 'আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানাইয়া দিতে বল, উহা কোনটি? আমরা গরুটি সম্পর্কে সন্দেহে পতিত হইয়াছি এবং আল্লাহ ইচ্ছা করিলে নিশ্চয় আমরা দিশা পাইব।'
____________________________________________________________________________
(৭১) মূসা বলিল, 'তিনি বলিতেছেন, উহা এমন এক গরু যাহা জমি চাষে ও ক্ষেতে পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত হয় নাই-সুস্থ নিখুঁত।' তাহারা বলিল, 'এখন তুমি সত্য আনিয়াছ।' যদিও তাহারা যবেহ করিতে উদ্যত ছিল না, তবুও তাহারা উহাকে যবেহ করিল। 
____________________________________________________________________________
  • বনী ঈসরাঈলীদের হযরত মূসা (আঃ) এর মাধ্যমে নির্দেশ দেন একটি গরু জবাই করতে। 
  • তারা এই পরমর্শকে ঠাট্টা বিদ্রুপ বলে মনে করে। 
  • মূসা (আঃ) বলেন, ঠাট্টা বিদ্রূপ করা অজ্ঞ লোকের কাজ। 
  • ইহুদীরা যখন বুঝতে পারলো যে গরু জবাই করতেই হবে তখন তারা  নানা টালবাহানা করা শুরু করে। 
  • তারা প্রথমে জানতে চাইল কোন ধরণের গরু।
  • মূসা (আঃ) জানালেন  বৃদ্ধ ও অল্প বয়সের মাঝামাঝি। অর্থ্যাত্‌ মধ্যবয়স্ক 
  • এর পর তারা জানতে চাইল রং কিরকম হবে? 
  • উত্তর আসল উজ্জ্বল গাঢ় বর্ণের হলুদ রংয়ের গরু যা দেখলে মানুষ আনন্দিত হয়।  
  •  এর পরেও তারা গরুকে চেনার আরো বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে চায়। 
  • মূসা (আঃ) জানান  এমন গরু যা কখনো চাষাবাদ বা সেচ কাজে ব্যবহার করা হয়নি এবং তার দেহে কোন রকম দাগ নেই। 
  • এরপর তারা গরুটিকে জবাই করে।
বনী ঈসরাঈলীদের ঘটনা ১৭।
এর প্রারম্ভিক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে ৭২ নং আয়াতে। বনী ঈসরাঈলীদের মধ্যে একজন খুন হয়ে যায়। হত্যাকারী কে তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। বনী ঈসরাঈলীরা হযরত মূসা (আঃ) এর খেদমতে হাজির হয়ে আরয করল, আমরা হত্যাকারীর সন্ধান পেতে চাই। হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে একটি গাভী যবাই করতে বলেন। এ কথা শোনার পর তারা তাদের স্বভাবগত কূট-তর্ক শুরু করে দেয়। প্রথমে প্রশান করে গাভীটির কি  গুণ থাকা চাই? দ্বিতীয় প্রশ্ন করে, তার বর্ণ নিয়ে। তৃতীয় প্রশ্ন আসে প্রথম প্রশ্নের উত্তরচট আরো পরিষ্কার করে দিতে। গাভীটির গুণাবলী কি কি হবে?  হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহর কাছ থেকে জেনে তাদের প্রশ্নের উত্তর দেন যা  ৭১ নং আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে।   

আমার অনুধাবন: 

  • যে কোন ঐশী  ধর্মে পারলৌকিক পুরস্কারের শর্ত হচ্ছে বিশ্বাস ও সত্‌ কর্ম।  
  • এই পৃথিবীতে  ভয় ও দুঃখ থেকে মুক্ত থাকতে হলে আল্লাহ ও আখেরাতে   বিশ্বাসী  এবং সত্‌কাজ করতে হবে। তাহলে আর অবিশ্বসী সম্প্রদায়ের মত শাস্তির ভয়ে সন্ত্রস্থ থাকতে হবে না। 
  • অতিরিক্ত লোভ ও স্বার্থপরতা মানুষের সম্মান ও মর্যাদাকে  ধ্বংস করে দেয়। বৈষয়িক স্বার্থ অর্জনের জন্য মানুষ আল্লাহর অবাধ্য হয় যা তাদেরকে কুফরী ও অবিশ্বাসের দিকে টেনে নেয়। 
  • নিয়তের উপর কর্মের ফলাফল নির্ভর করে। 
  • আল্লাহর বিধানকে অমান্য করায় বানরে রূপান্তরিত করা থেকে এই শিক্ষা নেয়া যায়  আল্লাহ  মানুষকে পশুতে রূপান্তরিত করেন। এভাবে আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে মানুষ দূরে সরে যায়। 
  • আল্লাহর নির্দেশ যদি পছন্দমত না হয় তবু সে নির্দেশকে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। 
  • বিচার প্রার্থনা করার ক্ষেত্রে ঠাট্টা  করা অজ্ঞ লোকদের কাজ। নবীগণ তা কখনো করেন না।  
  • আল্লাহর শাস্তি শুধু পরকালের জন্য নির্ধারিত তা নয়। মানুষকে শিক্ষা দেবার জন্য কোন কোন অপরাধের শাস্তি ইহকালেই দিয়ে থাকেন। 
  • গাভী নিয়ে এত প্রশ্ন করার ঘটনা থেকে শিক্ষা এই যে অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন বা অনুসন্ধানের পেছনে পড়া উচিত নয়। যে বিষয় যত সাদামাটা হয়  তাকে সে ভাবেই আমল করা উচিত। 
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url