সূরা বাকারা, রুকু - ১০।
কুরআন পড়ুন, বুঝে পড়ুন
নিজে জানুন, অন্যকে বলুন।
সূরা বাকারা, রুকু - ১০।
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
আয়াত ৮৩-৮৬।
ইহুদীদের অঙ্গীকার ও ভঙ্গ।
ভূমিকা:
এর আগের কয়েকটি আয়াতে বনী ঈসরাঈলীরা যে আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিল সে কথা বলা হয়েছে। অঙ্গীকারের বিষয়বস্তু বলা হয় নি। এই রুকুতে বনী ঈসরাঈলীদের অঙ্গীকারের কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে।
আয়াত অনুযায়ী আলোচিত বিষয়:
৮৩ নং আয়াত: ইহুদীদের প্রতি আল্লাহর কয়েকটি নির্দেশ এবং তাদের অঙ্গীকার।
____________________________________________________________________________
(৮৩) স্মরণ কর, যখন বনী ঈসরাঈলীদের অঙ্গীকার নিয়াছিলাম, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাহারও 'ইবাদত করিবে না, মাতাপিতা, আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন ও দরিদ্রদের প্রতি সদয় ব্যবহার করিবে এবং মানুষের সাথে সদালাপ করিবে, সালাত কায়েম করিবে ও যাকাত দিবে, কিন্তু স্বল্পসংখ্যক লোক ব্যতীত তোমরা বিরুদ্ধভাবাপন্ন হইয়া মুখ ফিরাইয়া নিয়াছিল।
____________________________________________________________________________
- আল্লাহ ব্যতীত আর কারো উপাসনা না করার অঙ্গীকার।
- পিতামাতা আনুগত্য ও তাদের সাথে উত্তম আচরণরে অঙ্গীকার।
- সমাজের দুঃস্থ বিশেষ করে আত্মীয়-স্বজন, এতিম ও গরীব-দুঃখীদের সাথে সদয় ব্যবহার ও সাহায্য করার অঙ্গীকার।
- সবার সাথে সদালাপ অর্থ্যাত্ উত্তম কথা বলার অঙ্গীকার।
- সালাত কায়েম করার অঙ্গীকার।
- যাকাত দেয়ার অঙ্গীকার।
- এই অঙ্গীকার পালন করে অল্প সংখ্যক লোক।
৮৪ নং আয়াত: বর্ণিত অঙ্গীকারের পরিশিষ্ট।
_________________________________________________________
(৮৪) যখন তোমাদের অঙ্গীকার নিয়াছিলাম যে, তোমরা পরস্পরের রক্তপাত করিবে না এবং আপনজনকে স্বদেশ হইতে বহিষ্কার করিবে না, অতঃপর তোমরা ইহা স্বীকার করিয়াছিলে, আর এই বিষয়ে তোমরাই সাক্ষী।
_________________________________________________________
- মানুষের প্রাণের নিরাপত্তা সংক্রান্ত অঙ্গীকার।
- মাতৃভূমি ও ঘরবাড়ির উপর মানুষের অধিকার।
- এই সব বিষয়ে ইহুদীরা নিজেরাই সাক্ষী।
ইহুদীদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কাহিনী:
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর আমলে ইহুদীদের কাজের নিন্দা করে নাযিল হয়েছে। তাওরাতে ইহুদীদেদর কয়েকটি কাজের আদেশ দেয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল (১) পরস্পর রক্তপাত করবে না (২) কাউকে দেশত্যাগে বাধ্য করবে না। (৩) কোন ইহুদী শত্রুর হাতে বন্দী হলে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নিবে। বনী ঈসরাঈলীরা তাওরাতের বিধানগওলোর মধ্যে শুধু শেষেরটি মানত।
রসুল (সঃ) এর যুগে মদীনায় মুশরিকদের দুটো গোত ছিল: বনু আউস ও বনু খাজরাজ। ইহুদীদের তিনটি গোত্র ছিল: বনু কায়নুকা, বনু নজির এবং বনু কুরায়জা। বনু আউসের মিত্র ছিল বনু কুরা্য়জা। বনু নজির এবং বনু কুরায়জা ছিল খাজরাজের মিত্র।
মদীনায় বসবাসকারী মুশরিকদের এই দুটি গোত্রের মধ্যে সুপ্রাচীন কাল থেকে বংশীয় শত্রুতা চলে আসছিল। যখন তাদের মধ্যে সংঘাত লাগত তখন ইহুদীদের গোত্র গুলি যার যার মিত্রদের পক্ষে পরস্পরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হত। এর ফলে ইহুদীদের নিজেদের অনেক লোক নিহত হত। এমনকি অনেক লোক ঘর-বাড়ী ত্যাগ করতে বাধ্য হত। অথচ তাওরাতে নিজেদের মধ্যে রক্তপাত না ঘটানো এবং বাস্তুচ্যুতি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাবার পর মুক্তিপণ দিয়ে ইহুদীদের মুক্ত হরত। এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তারা বলত আমাদের স্বজাতিকে মুক্ত করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআন মাজীদ বলছে, যে তাওরাততো এ আদেশ দিয়েছে যে হত্যা করবে না এবং বাস্তু চ্যুতি করবেনা। এসব আদেশ পরিত্যাগ করলে কিন্তু মুক্তিপণ দেয়ার আদেশ মান্য কর। ইহুদীদের দ্বিমুখী চরিত্রের নিন্দা এবং চরিত্রের বক্রতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে এই আয়াত নাযিল হয়।
৮৫ ও ৮৬ নং আয়াত: প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা এবং তিরস্কার ও শাস্তির আভাষ:
____________________________________________________________________________
(৮৫) তোমরাই তাহারা যাহারা অতঃপর একে অন্যকে হত্যা করিতেছ এবং তোমাদের এক দলকে স্বদেশ হইতে বহিষ্কার করিতেছ, তোমরা নিজেরা তাহাদের বিরুদ্ধে অন্যায় ও সীমালংঘন দ্বারা পরস্পরের পৃষ্ঠপোষকতা করিতেছ এবং তাহারা যখন বন্দীরূপে তোমাদের কাছে উপস্থিত হয় তখন তোমরা মুক্তিপণ দাও; অথচ তাহাদের বহিষ্করণই তোমাদের জন্য অবৈধ ছিল। তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশকে প্রত্যাখ্যান কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যাহারা এরূপ করে তাহাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনে হীনতা এবং কিয়ামতের দিন তাহারা কঠিনতম শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হইবে।তাহারা যাহা করে আল্লাহ সে সম্বন্ধে অনবহিত নন।
____________________________________________________________________________
(৮৬) তাহারাই আখিরাতের বিনিময়ে পার্থিব জীবন ক্রয় করে; সুতরাং তাহাদের শাস্তি লাঘব করা হইবে না এবং তাহারা কোন সাহায়্যপ্রাপ্ত হইবে না।
____________________________________________________________________________
- বনী ঈসরাঈলীদের তিনটি গুরত্ব পূর্ণ নির্দেশ দেয়া হয় প্রথমত: হত্যা না করা, দ্বিতীয়ত দেশ ত্যাগে বাধ্য না করা। তৃতীয়ত , শত্রুদের হাতে বন্দী হলে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে দেয়া।
- তারা নির্দেশ না মেনে পরস্পরকে হত্যা করে এবং দেশ থেকে বহিষ্কার করে যা তাওরাতের নির্দেশের স্পষ্ট সীমালংঘন।
- হত্যা ও বহিষ্কার করা মারাত্মক অন্যায় কাজ।
- দেশছাড়া করায় বহিস্কৃতরা অনেক বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়ত এবং শত্রুদের হাতে বন্দী হত।
- তখন আবার শত্রুদের হাতে বন্দীকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নিত 'তাওরাতে' নির্দেশ আছে বলে।
- অথ্যাত্ ইহুদীরা তাদের সুবিধামত তাওরাতের কিছু নির্দেশ বিশ্বাস ও মান্য করে। আবার কিছু অংশ অবিশ্বাস ও প্রত্যখ্যান করে।
- তাই এই আয়াতে প্রশ্ন তোলা হয়েছে এটা কোন ধরণের আনুগত্য?
- যারা এই দ্বিমুখী আচরণ করে তাদের জন্য রয়েছে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা এবং কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তি।
- যারা এ ধরণের কুফর করে আল্লাহ সে সম্পর্কে স্পষ্টভাবে অবহিত।
- মহান আল্লাহর শাস্তি হতে বাঁাচার কোন সুযোগই তাদের থাকবে না।
আমার অনুধাবন:
- মহান আল্লাহর কাছে সব মানুষ সমান।
- ইসলামের নৈতিক অনুশাসন সর্ব কালের, সর্ব জাতির জন্য প্রযোজ্য। আল্লাহর এই আইন অমান্য করলে আল্লাহর শাস্তি বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী সবার জন্য প্রযোজ্য।
- মানুষের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলতে হবে এবং অসুন্দর কথাকে প্রতিহত করতে হবে।
- ইহুদীদের মানসিকতা এরূপ ছিল যে, একদিকে আল্লাহর হুকুম অমান্য করত। আবার অপরদিকে অন্যদের ধার্মিকতা প্রদর্শন করত - যা করা থেকে আমাদের দূরে থাকেতে হবে।
- আমাদের সমাজে দেখা যায় আমরা বলি আল্লাহ ও তাঁর কিতাবকে বিশ্বাস করি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করতে গিয়ে আমরা কোন কোন নির্দেশ মানি, আবার অনেকগুলি প্রত্যখ্যান করি। আল্লাহর কাছে এ ধরণের অসম্পূর্ণ আনুগত্য অগ্রহণীয়।
- আমরা যদি আল্লাহর নির্দেশ বিশ্বাস ও পালনের ক্ষেত্রে দ্বিমুখী চরিত্র অবলম্বন করি তবে পার্থিব জীবনে আছে লাঞ্ছনা আর কিয়ামতের দিন আছে কঠিনতম শাস্তি।
- উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় বর্তমানে আমাদের সমাজে সালাত-রোজা সবই করছে আবার অসত্ পথে অর্থ আয় করে তা থেকে দান করছে। অথচ অসত্ পথে আয় স্পষ্টতঃ নিষেধ। এ ধরণের মানসিকতা পরিহার করতে হবে।