সূরা বাকার, রুকু -৪।

 কুরআন পড়ুন, বুঝে পড়ুন
     নিজে জানুন, অন্যকে বলুন। 



সূরা বাকারা,  রুকু - ৪ ।

দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।

আয়াত ৩০ - ৩৯

 হযরত আদম (আঃ)কে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বর কাহিনী

আগের আয়াতে আল্লাহ তা'য়ালা মানুষকে যে অফুরন্ত বস্তুগত নেয়ামত দিয়েছেন তা বর্ণনা করার পর এই রুকু শুরু হয়েছে মানুষকে যে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে  তা বর্ণনা করার মাধ্যমে। 


আয়াত অনুযায়ী আলোচ্য বিষয়:
০ নং আয়াত: আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের বিশেষ মর্যাদা।

____________________________________________________________________
(৩০) স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফিরিশতাদের বলিলেন, "আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করিতেছি', তাহারা বলিল, 'আপনি কি সেখানে এমন কাহাকেও সৃষ্টি করিবেন, যে অশান্তি ঘটাইবে ও রক্তপাত করিবে? আমরাই তো আপনার সপ্রশংস স্তুতিগান ও পবিত্রতা ঘোষণা করি। তিনি বলিলেন,
নিশ্চয়ই আমি যাহা জানি তাহা তোমরা জান না।___________________________________________________
  • আল্লাহর প্রতিনিধি মানুষ সৃষ্টির পর ফেরেশতাদেরকে তাদের বিশেষ মর্যাদা ও গুণাবলী সম্পর্কে অবহিত করেন।
  • ফেরেশতারা উত্‌কণ্ঠা প্রকাশ করে যে তারা পৃথিবীতে রক্তপাত ঘটাবে এবং অশান্তি সৃষ্টি করবে।
  • ফেরেশতারা আল্লাহর কাছে প্রশ্ন রাখেন কিভাবে তাদেরকে প্রতিনিধি বানানো হবে?
  • ফেরেশতারা মনে করেন এমন কাউকে প্রতিনিধি বানানো উচিত যারা সব ধরণের পাপ-পঙ্কলিতা মুক্ত।
  • দৃষ্টান্ত হিসাবে নিজেদের তুলে ধরেন যে তারা সব সময় আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা করছেন।
  • ফেরেশতাদের প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহ বলেন, তোমরা মানুষের দুর্বল দিক দেখছ। মানুষের মর্যাদা ও বিশেষ গুণাবলী সম্পর্কে আমি যা জানি তোমরা তা জান না।
৩১ নং আয়াত: মানুষের জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্ব।  
____________________________________________________________________________
(৩১)আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তারপর সেই সমুদয় ফিরিশতাদের সম্মুখে প্রকাশ করিলেন এবং বলিলেন, 
এই সমুদয়ের নাম আমাকে বলিয়া দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।' 
____________________________________________________________________________
(৩২) তাহারা বলিল, 'আপনি মহান, পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যাহা শিক্ষা দিয়াছেন তাহা ছাড়া আমাদেরতো কোন জ্ঞানই নাই। বস্তুত আপনি জ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময়। 
____________________________________________________________________________
  • মহান আল্লাহ আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করে এই  বিশ্বজগতের সব জিনিসের  নাম ও প্রকৃতি  শিক্ষা দেন। 
  • এই জ্ঞান মানুষের সহজাত। অর্থ্যাত্‌ এই সহজাত জ্ঞানের দ্বারা মানুষ যে কোন বস্তু চিনতে পারে। 
  • মহান আল্লাহ  ফেরেশতাদের পরীক্ষা নেন এবং তাতে তাদের ভুল ভাঙ্গে। 
  • ফেরেশতারা বুঝেন আল্লাহর প্রতিনিধি হবার জন্য এবাদত এবং উন্নত জ্ঞনের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। 
  • ফেরেশতারা অদৃশ্য জগত সম্পর্কে ততটুকু জানে যতটুকু তাদের শিখানো হয়েছে। 
  • ফেরেশতারা ঘোষণা করেন আল্লাহ মহান পবিত্র । 
  • ফেরেশতারা আল্লাহ তাঁদের যা শিক্ষা দিয়েছেন তার বাইরে কিছু জানে না।
  • ফেরেশতারা প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করার পর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। 
  • মহান পবিত্র আল্লাহ সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী এবং প্রতিটি কাজ যুক্তি ও জ্ঞানের আলোকে সম্পন্ন করেন। 
  • আল্লাহ সর্বজ্ঞ। তিনি সব দেখেন, সব শুনেন। 
৩৩ নং আয়াত: মানুষকে প্রদত্ত বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক নেয়ামত। 
____________________________________________________________________________
(৩৩) তিনি বলিলেন, 'হে আদম! তাহাদিরকে এই সকল নাম বলিয়া দাও। সে তাহাদেরকে এই সকলের নাম বলিয়া দিলে তিনি বলিলেন, 'আমি কি তোমাদেরকে বলি নাই যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অদৃশ্য বস্তু সম্বন্ধে আমি নিশ্চিতভাবে অবহিত এবং তোমরা যাহা ব্যক্ত কর বা গোপনে রাখ আমি তাহাও জানি? 
____________________________________________________________________________
  •  আল্লাহ  মানুষকে বিশেষ ক্ষমতা ও যোগ্যতা দিয়েছেন যা ফেরেশতাদের দেন নি। 
  • আল্লাহ আদম (আঃ) কে ফেরেশতাদের সব নাম বলতে আদেশ দেন। 
  • মহান আল্লাহ আসমান ও যমীনের প্রতিটা  সৃষ্টির  প্রকাশ্য ও অন্তরের সব বিষয় তিনি জানেন।  
৩৪ নং আয়াত : ফেরেশতাদের আদম (আঃ)কে সিজদা দেবার নির্দেশ
____________________________________________________________________________
(৩৪ ) যখন ফিরিশতাদের বলিলাম, 'আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করিল; সে অমান্য করিল ও অহংকার করিল। সুতরাং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হইল। 
____________________________________________________________________________
  • মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে ফেরেশতাদের মানুষকে সিজদা করতে বলেন। 
  • ইবলীস অহংকার ও আত্মরম্ভীতার কারণে  আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে। 
  • তার ধারণা সৃষ্টির দিক দিয়ে সে আদম (আঃ) এর থেকে শ্রেষ্ঠ।
  • আল্লাহর নির্দেশ পালন না করায় সে কাফের হয়ে যায়।  
৩৫  নং আয়াত: আল্লাহর নিষেধ। 
____________________________________________________________________________
(৩৫) এবং আমি বলিলাম, 'হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেথা ইচ্ছা স্বচ্ছন্দে আহার কর, কিন্তু এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হইও না; হইলে তোমরা অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হইবে। 
____________________________________________________________________________
  • আদম (আঃ) ও তাঁর স্ত্রীকে জান্নাতে বসবাস করতে বলেন। 
  • মহান আল্লাহ তাদের জন্য সব ধরণের খাবার ও ফলমূলের ব্যবস্থা করেন
  • একটি বিশেষ বৃক্ষের কাছে যেতে  নিষেধ করেন, যার কাছে গেলে তাদের নিজের আত্মার উপর জুলুম হবে।  
৩৬ নং আয়াত: শয়তানের প্রতিহিংসা।
____________________________________________________________________________(৩৬) কিন্তু শয়তান উহা হইতে তাহাদের পদস্খলন ঘটাইল এবং তাহারা যেখানে ছিল সেখান হইতে তাহাদেরকে বহিষ্কার করিল। আমি বলিলাম, 'তোমরা একে অন্যের শত্রুরূপে নামিয়া যাও, পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল। 
____________________________________________________________________________
  • শয়তানের কুমন্ত্রণায় তারা আল্লাহর নিষেধ অমান্য করলেন এবং নিষিদ্ধ ফল খান। 
  • আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করায় আল্রাহ তাদের বেহেশত থেকে বের করে দিলেন। 
  • শয়তান ও মানুষকে একে অপরের শত্রুতে রূপান্তরিত করলেন। 
  • একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তারা এই পৃথিবীতে বসবাস করবে। 
  • মানুষকে পৃথিবীতে অবস্থানের  সময় জীবিকা আহরণ করতে হবে।   
৩৭ নং আয়াত: গুনাহ ও তওবা। 
____________________________________________________________________________
(৩৭) অতঃপর আদম তাহার প্রতিপালকের নিকট হইতে কিছু বাণী প্রাপ্ত হইল। আল্লাহ তাহার প্রতি ক্ষমাপরবণ হইলেন। নিশ্চয়ই তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। 
____________________________________________________
  • আদম (আঃ) তাঁর ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা করেন। 
  • মহান আল্লাহ তাকে কিভাবে তওবা এবং অনুশোচনা করবে সে  ভাষা শিখিয়ে  দিলেন।  
  • আদম (আঃ) সত্যিকারের তওবা আল্লাহ কবুল করেন এবং ক্ষমা করে দেন। 
  • আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল এবং পরম  দয়ালু। 
বি.দ্র: আরবীতে 'তওবা' কথাটির অর্থ প্রত্যবর্তন করা বা ফিরিয়া আসা। আল্লাহর কাছে কৃত পাপের ক্ষমা চাওয়াকে 'তাওয়াফ' বলা হয়েছে। তওবার তিনটি ধাপ। প্রথমত: পাপী ব্যক্তি তার কৃত পাপকে সনাক্ত করবে। দ্বিতীয়তঃ সনাক্ত করার পর সে পাপ কাজকে পরিত্যাগ করবে। তৃতীয়ত: ভবিষ্যতে এই পাপ করবে না বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকবে।  

৩৮  নং আয়াত: আদম (আঃ) এর প্রতি শাস্তি।
____________________________________________________________________________
(৩৮) আমি বলিলাম, 'তোমরা সকলেই এই স্থান হইতে নামিয়া যাও। পরে যখন আমার পক্ষ হইতে তোমাদের নিকট সত্‌পথের কোন নির্দেশ আসিবে তখন যাহারা আমার সত্‌পথের নির্দেশ অনুসরণ করিবে তাহাদের কোন ভয় নাই এবং তাহারা দুঃখিতও হইবে না।'  
____________________________________________________________________________
  • আল্লাহর নির্দেশে  আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়াকে বেহেশত থেকে বেরিয়ে এই পৃথিবীতে নেমে আসতে হয়।
  • আল্লাহ তাদের সত্‌পথে চলার উপকরণ অর্থ্যাত্‌ কিতাব ও রাসুল পাঠাবার প্রতিশ্রুতি দেন। 
  • মানুষের মধ্যে যে দল আল্লাহর  আদেশ নিষেধ অনুসরণ করবে তাদের কোন ভয় থাকবে না। 
  • তারা দুঃখিত হবে না। 
  • সত্‌পথ অনুসারী ব্যক্তির মধ্যে কোন উদ্বেগ ও উত্‌কণ্ঠা থাকবে না। প্রকৃত শান্তিকত বসবাস করবে।

৩৯ নং আযাত: জাহান্নামবাসী। 
____________________________________________________________________________
(৩৯) যাহারা কুফরী করিবে এবং আমার নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করিবে তাহারাই অগ্নিবাসী, সেখানে তাহারা স্থায়ী হইবে। 
____________________________________________________________________________
  • আল্লাহর নির্দেশিত পথ ত্যাগ করে
  • আল্লাহর নিদর্শন কুরআন ও অন্যান্য আসমানী কিতাবকে অস্বীকার করে  তাদের স্থান জাহান্নাম। 
  • জাহান্নামের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হবে। 

আমার অনুধাবন:

  • সৃষ্টি জগতে সব সৃষ্টির মধ্যে মানুষের মর্যাদা এত উপরে যে আল্লাহ মানুষকে এই পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি বানিয়েছেন। 
  • সকল সৃষ্টির উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তি এবং চিন্তা শক্তি।
  • মানুষের জ্ঞানার্জন ও শিক্ষার যোগ্যতা আছে।  
  • ফেরেশতারা আল্লাহর প্রশংসা ও এবাদতে অগ্রগামী হয়েও পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হতে পারে নি। এ থেকে আমার অনুধাবন কেবল ইবাদত মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়। 
  • আল্লাহ জানতেন এক শ্রেণীর মানুষ ভুল পথে চলবে, তারপরেও মানুষকে প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করেন নি। 
  • কোন কিছু সম্পর্কে জানার জন্য প্রশ্ন করতে দোষ নেই।
  • মানব জাতির প্রথম শিক্ষক হলেন মহান আল্লাহ। 
  • শয়তানের আনুগত্য মানুষকে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। 
  • মানুষের একটি ভুলের জন্য গোটা জাতিকে এর ফল ভোগ করতে হয়। আদম (আঃ) এর একটি ভুলের জন্য তিনি ও তার ভবিষ্যত বংশধররা বেহেশত থেকে বহিস্কৃত হন। 
  • মানুষকে আল্লাহর নির্দেশ  মেনে চলবে কি চলবে না এর জন্য ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন। 
  • আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য কোন কাজ করাই ইবাদত। 
  • আল্লাহর সামনে অহংকার ও আত্মরম্ভীতা প্রদর্শন করলে ঈমান থাকে না। 
  • আল্লাহর নিষিদ্ধ কোন কাজ করলে ক্ষতি মূলত মানুষেরই হয়। কারণ মানুষ আল্লাহর নেয়ামত হতে বঞ্চিত হয়। 


   

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url