সূরা বাকারা, রুকু - ২
কুরআন পড়ুন, বুঝে পড়ুন
নিজে জানুন, অন্যকে বলুন।
সূরা বাকারা, রুকু - ২।
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
আয়াত ৮ - ২০।
মুনাফিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
আয়াত অনুযায়ী আলোচ্য বিষয়:
৮ নং আয়াত : দুমুখো নীতি।
____________________________________________________________________________
(৮) আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও রহিয়াছে যাহারা বলে, 'আমরা আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান আনিয়াছি, কিন্তু তাহারা মুমিন নয়।
____________________________________________________________________________
- সমাজে এমন কিছু লোক আছে যারা মুখে ঈমান অর্থ্যাত্ গায়েবে বিশ্বাসের কথা বলে।।
- কিন্তু কর্মকান্ডে মোটেই ঈমানদার বা বিশ্বাসী নয়।
- তারা মিথ্যা দাবী করে।
৯ নং আয়াত: প্রতারণা।
____________________________________________________________________________
(৯) আল্লাহ ও মুমিনগণকে তাহারা প্রতারিত করিতে চাহে। অথচ তাহারা যে নিজেদেরকে ভিন্ন কাহাকেও প্রতারিত করে না, ইহা তাহারা বুঝিতে পারে না।
____________________________________________________________________________
- তারা আল্লাহ এবং বিশ্বাসী বান্দাদের সাথে প্রতারণা করতে চায়।
- আল্লাহ তাদের গোপন অভিসন্ধি সম্পর্কে অবশ্যই জানেন।
- আল্লাহকে তারা ধোঁকা দিতে পারে না।
- প্রকৃত অর্থে এই ধোঁকার প্রতিক্রিয়া তাদের নিজেদের উপর প্রত্যাবর্তিত হয়।
বি.দ্র. মুনাফিকদের এমন অসুস্থ লোকের সাথে তুলনা করা যায়, যে ব্যক্তি চিকিত্সকের কাছে তার অসুস্থতা সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয় এবং চিকিত্সকের দেয়া ব্যবস্থাপত্র অনুসরণ করেন না। সে মনে করে সে চিকিত্সককে ধোঁকা দিতে পেরেছে। আসলে সে নিজেকে ধোঁকা দেয় এবং অসুস্থ হয়ে পড়ে। কুরআনে বর্ণিত মুনাফিকরা এরকম।
১০ নং আয়াত: মুনাফিকদর মানসিক অসুস্থতা ।
____________________________________________________________________________(১০) তাহাদের অন্তরে ব্যাধি রহিয়াছে। অতঃপর আল্লাহ তাহাদের ব্যাধি বৃদ্ধি করিয়াছেন ও তাহাদের জন্য রহিয়াছে কষ্টদায়ক শাস্তি, কারণ তাহারা মিথ্যাবাদী ।
____________________________________________________________________________
- মুনাফিকদের মনেে মধ্যে আছে সত্য প্রত্যাখানের মারাত্মক ব্যাধি। 'মারাদুন' অর্থ ব্যাধি। আত্মিক দিক দিয়ে এর অর্থ মুর্খতা, হিংসা, অবিশ্বাস, সংশয়, চির দুশ্চিন্তা, হিংসা, স্বার্থপরতা।
- পথভ্রষ্টতাকে তারা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে এবং সংকল্পে অটল থাকে।
- তাদের জেদের কারণে এই মানসিক ব্যাধি ক্রমাগত বৃদ্ধি করে দেন।
- মিথ্যা বলা হারাম। মিথ্যাচারীর জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।
- তারা ঈমান আনার তাওফীক হারিয়ে ফেলে।
- আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাময় কষটদায়ক শাস্তি।
১১ ও ১২ নং আয়াত: অশান্তি সৃষ্টিকারী।
____________________________________________________________________________
(১১) তাহাদের যখন বলা হয়. 'পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করিও না', তাহারা বলে, 'আমরাই তো শান্তি স্থাপনকারী' ।
(১২) সাবধান! ইহারাই অশান্তি সৃষ্টিকারী, কিন্তু ইহারা বুঝিতে পারে না।__________________________________________________________________________
- মুনাফিকরা নিজের দোষকে গুণ ও অপরের গুণকে দোষ মনে করে।
- তারা তাদের মুনাফেকী কাজ দ্বারা ফেত্না ফ্যাসাদ (অশান্তি, হাঙ্গামা, সন্ত্রাস) করে থাকে।
- তারা তাদের মুর্খতার কারণে নিজেদের দাবী করে সংশোধনকারী , অশান্তি দূরকারী এবং তারা উন্নতি করার চেষ্টায় লেগে আছে।
- তারা অসত্যকে সত্য রূপে দেখতে পেত।
- অশান্তি সৃষ্টির কুফল সম্পর্কে বলতে গিয়ে ১২ নং আয়াতের শেষ শব্দ 'লা ইয়াশউরুন' বলা হয়েছে। কারণ ফ্যাসাদ বা অশান্তি অনুভব করতে গভীর জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না।
১৩ নং আয়াত: মুনাফিকদের মুর্খতা।
____________________________________________________________________________
(১৩) যখন তাদের বলা হয়, যে সকল লোক ঈমান আনিয়াছে তোমরাও তাহাদের মত ঈমান আনয়ন কর, তাহারা বলে, 'নির্বোধগণ যেরূপ ঈমান আনিয়াছে আমরাও কি সেইরূপ ঈমান আনিব? সাবধান! ইহারাই নির্বোধ, কিন্তু ইহারা জানে না।
____________________________________________________________________________
- সম্ভবত দুর্বল মুসলমানরা তাদের ঈমান আনার আহ্বান জানালে ঈমান আনতে অস্বীকার করত।
- বিশ্বাসীদের তাদের চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী নির্বোধ ভাবে।
- আল্লাহ তাদেরই নির্বোধ বলেছেন।
- তারা নিজেদের সম্পর্কে অজ্ঞ।
- আল্লাহ বিশ্বাসীদের সতর্ক করেছেন যাতে তারা ধোঁকা না খায়।
- ঈমান প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শেষ শব্দ আরবীতে 'লা ইয়'লামুন' বা তারা বুঝতে পারেনা বলা হয়েছে। কারণ বিশ্বাস ও ধর্মানুভূতি গভীর অভিনিবেশের দাবী রাখে ।
১৪ নং আয়াত: মুনাফিকদের সুযোগ সন্ধানী ও দুমুখো নীতি। (এই রুকুতে ২ বার বলা হয়েছে)
____________________________________________________________________________
(১৪) আর তারা যখন ঈমানদারদের সাথে মিশে , তখন বলে আমরা ঈমান এনেছি। আবার যখন তাদের শয়তানের সাথে একান্তে সাক্ষাত্ করে, তখন বলে, আমরা তোমাদের সাথে রয়েছি-আমরা তো (মুসলমানদের সাথে) উপহাস করি মাত্র।____________________________________________________________________________
- ঈমানদারদের সাথে মিশলে বলে ঈমান এনেছি।
- শয়তানের সাথে বলে আমরা মুমিনদের উপহাস করেছি।
- তারা মুমিন ও তার দলের লোক উভয়কে খুশী রাখতে চায়।
- তারা মুমিনদের সাথে উপহাস ওবিদ্রূপমূলক কার্য়কলাপ করে।
বি.দ্র: এই আয়াতে 'তাদের শয়তান' বলতে কুরাইশ ও ইহুদীদের.সে সব নেতৃবর্গকে বোঝানো হয়েছে যারা মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র কার্যক্রমে উত্সাহ দিত।
১৫ নং আয়াত: আল্লাহর উপহাসের পাত্র। _________________________________________________________________________
(১৫) বরং আল্লাহই তাদের সাথে উপহাস করেন। আর তাদেরকে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন যেন তারা নিজেদের অহংকার ও কুমতলবে হয়রান ও পেরেশান থাকে।
____________________________________________________________________________
- মহান আল্লাহ মুনাফিকদের সাথে উপহাস করে অর্থ মুনাফিকদের তামাশা মুনাফিকদের ফিরিয়ে দেন।
- আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দুনিয়াতে আপাতত কিছু বলছেন না, যার ফলে তারা তাত্ক্ষণিক শাস্তির সম্মুখীন হচ্ছে না।
- তাদের গোমরাহী দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতেই থাকে।
- আল্লাহ তাদের অকস্মাত্ ধরবেন এবং শাস্তি দিবেন।
১৬ নং আয়াত: মুনাফিকদের অলাভজনক ব্যবসা।
____________________________________________________________________________
(১৬) তারা সে সমস্ত লোক, যারা হেদায়েতের বিনিময়ে গোমরাহী খরিদ করে । বস্তুতঃ তারা তাদের এ ব্যবসায় লাভবান হতে পারেনি এবং তারা হেদায়েতও লাভ করতে পারে নি।
____________________________________________________________________________
- তারা হেদায়েতের মত উত্কৃষ্ট জিনিসের বদলে গোমরাহীর মত নিকৃষ্ট জিনিস গ্রহণ করে।
- তাদের ভাল ব্যবসায়িক বুদ্ধি নেই।
- তারা তাদের আত্মাকে লোভ-লালসা, অন্যায় ও অসত্যের কাছে বিক্রী করে দেয়।
১৭ হতে ২০ নং আয়াত: মুনাফিকদের দৃষ্টান্ত।
____________________________________________________________________________
(১৭) তাদের অবস্থা সেই ব্যক্তির মত, যে লোক কোথাও আগুন জ্বালালো এবং তার চার দিককার সবকিছুকে যখন আগুন স্পষ্ট করে তুললো ঠিক এমনি সময় আল্লাহ তার চারদিকের আলোক উঠিয়ে নিলেন এবং তাদেরকে অন্ধকারে ছেড়ে দিলেন। ফলে,তারা কিছুই দেখতে পায় না।
___________________________________________________________________________
(১৮) তারা বধির, মূক ও অন্ধ । সুতরাং তারা ফিরে আসবে না।
____________________________________________________________________________
(১৯) আর তাদের উদাহরণ সে সব লোকের মত যারা দুর্যোগপূর্ণ ঝড়ো রাতে পথ চলে, যাতে থাকে আঁধার, গর্জন ও বিদ্যুত্চমক। মৃত্যুর ভয়ে গর্জনের সময় কানে আঙ্গুল দিয়ে রক্ষা পেতে চায়। অথচ সমস্ত কাফেরই আল্লাহ কর্তৃক পরিবেষ্টিত।
____________________________________________________________________________
(২০) বিদ্যুতালোকে যখন সামান্য আলোকিত হয়, তখন কিছুটা পথ চলে। আবার যখন অন্ধকার হয়ে যায়, তখন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন, তাহলে তাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টি শক্তি ছিনিযে নিতে পারেন। আল্লাহ যাবতীয় বিষয়ের উপর সর্বময় ক্ষমতাশীল।
____________________________________________________________________________
- প্রথম দৃষ্টান্তে. মুনাফিকদের এমন ব্যক্তির সাথে তুলনা করা হয়েছে যে ব্যক্তি আলো পেয়ে আবার অন্ধকারে পড়ে যায়।
- মুনাফিকরা সত্য প্রকাশের পরও গোমরাহীর অন্ধকারে থাকে।
- দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে মুনাফিকদের বধির, মূক ও অন্ধের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
- তারা কখনো ফিরে আসবে না । কারণ তাদের কান সত্য কথা শ্রবণ করে না। মুখে সত্য কথা বলতে পারে না এবং চোখও সত্য পথ দেখতে পারে না
- তৃতীয় দৃষ্টান্তে বজ্রধ্বনি সহ প্রচন্ড বৃষ্টিপাতে পথ চলা ব্যক্তির সাথে তুলনা করা হয়েছে। বৃষ্টিতে পথ চলতে গিয়ে কখনো থেমে যায় আবার সুযোগ বুঝে অগ্রসর হয়। সেরকম মুনাফিকরা সত্য পথের অগ্রগতি দেখে কখনো অগ্রসর হয় আবার কখনো স্বার্থপরতার অন্ধকারে পতিত হলে সত্য পথ চলা থেকে বিরত থাকে।
- আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন আল্লাহ সব কিছুর উপরে শক্তিমান।
আমার অনুধাবন:
- ঈমান মৌখিক বিষয় নয়, অন্তরের ব্যাপার। কোন ব্যক্তিকে চিনতে হলে তার মৌখিক বক্তব্যকে যথেষ্ট বলে মনে করা উচিত নয়।
- মুনাফিক বলতে বোঝায় সে ব্যক্তিকে যারা মুখে বলে এক কথা আর অন্তর বলে আরেক কথা । তারা সব সময় অবিশ্বস্ত, নীতিজ্ঞান শূন্য এবং সুবিধাবাদী।
- বাহ্যিক চেহারা ও আচরণ দেখে বোঝা যায় না কে মুমিন আর কে মুনাফিক। তাই সতর্ক থাকতে হবে
- মুনাফিকদের মত কোন অবস্থাতেই সমাজে অশান্তি বা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা যাবে না।
- মুনাফিকদের দ্বিমুখী চরিত্র অনুকরণ করা যাবে না।
- অশান্তি সৃষ্টিকারী এবং নির্বোধ মুনাফিক হতে সাবধান থাকতে হবে।
- মিথ্যা কথা বলা যাবে না।
- আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং কোন কাজই তাঁর অসাধ্য নয়।
বি,দ্র: সংক্ষেপে মুনাফিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট:
- কপটতা ও দ্বিমুখী চরিত্রের অধিকারী।
- দুনৌকায় আরোহণকারী।
- মৌখিক কথা এক রকম এবং কর্মকান্ড আরেক রকম।
- মানুষকে প্রতারণা ও ধোঁকা দেয়।
- অঙ্গীকার ভঙ্গকারী।
- অযৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক।
- নিজেদের সাথে প্রতারক।
- মিথ্যাবাদী।
- সত্য বুঝতে অক্ষম।
- হিংসুক মনোভাবাপন্ন।
- উচ্চমন্যতা।
- নিজেকে মীমাংসাকারী ভাবা।
- সংস্কারের নামে অশান্তি সৃষ্টি।
- বিবেকের অনুপস্থিতি।
- অজ্ঞ ও নির্বোধ।
- নিজের দোষকে গুণ এবং অপরের গুণকে দোষ মনে করে।
- রূপ বদলকারী ।
- মুমিনদের উপহাস করে।
- সততা ও নৈতিকতা নেই।
- হিদায়েতের পরিবর্তে তোমরাহী পছন্দ।